টুটুল স্কুলের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কোনরকমে জামাকাপড় ছেড়ে খেলতে যাবে বলে দৌড়ল। মার চিৎকার শুনতে পেল, ওকে খেয়ে নিয়ে খেলতে যেতে বলছে। ওকে বাধ্য হয়েই আবার বাড়িতে ফিরতে হল। কোনরকমে খাবারটা গিলে ছুট লাগালো মাঠের দিকে। ওর বন্ধুরা এতক্ষণে সবাই এসে গেছে। হয়তো ওর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। খেলার মাঠ বাড়ির কাছেই, খুব বেশি সময় লাগে না। দেখল বন্ধুরা সবাই এসে গেছে, খেলা শুরু হবার তোড়জোড় চলছে। মাঠটা মাঝারি মাপের। তারই একদিকে দু'দিকে গোলপোস্টের জায়গায় ইট রেখে ফুটবল খেলার ব্যবস্থা। জনা চৌদ্দ পনেরো বারো তেরো বছরের ছেলে ঐ মাঠে বল নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে। এটা হচ্ছে খেলা শুরুর আগের ওয়ার্ম আপ। টুটুল এসে মাঠের ধারে বসে পড়ল।
টুটুল ফুটবল খেলতে পারে না বলে ওর বন্ধুরা ওকে খেলায় নেয় না। ও নিজেও সেটা জানে, বুঝতে পারে। তাই, দুঃখ পায়না। খেলা শুরু হওয়ার পর মাঠের ধারে বসে দু'পক্ষেরই হয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটায় আর যখন বল মাঠের বাইরে চলে যায় তখন সেই বল কুড়িয়ে নিয়ে এসে মাঠে ফেরত পাঠায়। এতেও ওর আনন্দ। ও যে খেলছে না, ওকে খেলায় নেওয়া হচ্ছে না তা কখনও মাথায় আসে না। ও দেখেছে কিছু কিছু জিনিস ওর দ্বারা হয় না। যেমন, অঙ্ক। এত ভালো করে সব অঙ্ক কষে যাওয়ার পরেও পরীক্ষার খাতায় সেই অঙ্ক কনফিডেন্সের অভাবে ভুল করে বসে। কীভাবে অঙ্কটা কষবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারে না। শুধু কী পরীক্ষার খাতা? ক্লাসে টিচার অঙ্ক কষতে দিলেও ভুল করে। অথচ বাড়িতে সেসব অঙ্ক পটাপট কষে ফেলে। পরীক্ষার হলে বা ক্লাসে কী যে হয়! শুধু অঙ্ক কেন, সব বিষয়েই ওর এরকম অবস্থা। ওর মা বাবা এর জন্য কম চিন্তিত নয়। স্কুলের রেজাল্ট আনতে যাওয়ার সময় পড়াশোনা নিয়ে টিচাররা কমপ্লেন করেন। কনডাক্টে কিন্তু ওর এ প্লাস বাঁধা। ওর মতো বাধ্য আর মনোযোগী ছাত্র কম আছে।
ফুটবল খেলতে ও ভয় পায়। ফুটবল বডি কনট্যাক্ট গেম। দেহের যে কোনও অংশে, বিশেষত পায়ে চোট আঘাত লাগার সম্ভাবনা আছে। খুব ছোট বেলায় একবার সত্যিকারের ফুটবলে শট্ মারতে গিয়ে পা মচকে গিয়েছিল। সেই স্মৃতি এখনও মনের মধ্যে রয়ে গেছে। তাই, প্রথম প্রথম বন্ধুদের কথায় খেলতে নেমে দেখেছে ওর দ্বারা ফুটবল খেলা সম্ভব নয়। কাউকে চার্জ করে তার পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া অথবা পায়ে বল নিয়ে একের পর এক প্লেয়ারকে কাটিয়ে ড্রিবল করে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ওর মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করে, যদি পায়ে লেগে যায়, তাহলে কী হবে?
টুটুল মাঠের বাইরে বসে মাঠের ভিতর ছুটোছুটি করতে থাকা বন্ধুদের দেখছিল আর এসবই ভাবছিল। ওরা টিম তৈরি করছে। দু'দলে ভাগ হয়ে তারপর খেলা শুরু করবে। সমস্যা দেখা গেল টুটুলকে বাদ দিয়ে মাঠে তেরোজন উপস্থিত আছে। দুটো টিম করতে হলে একটা টিমে ছয়জন আর অন্য টিমে সাতজন হয়। তা না হলে, একজনকে বসতে হয়। কেউ বসতে রাজি নয়। হঠাৎ ওদেরই একজন টুটুলকে খেলাতে বলল। এতে চৌদ্দজন হলে দুটো টিম বানানো সম্ভব। টুটুলের তীব্র আপত্তি কেউ শুনল না, ওকে জোর করে মাঠে নামানো হল। অনেক আলাপ আলোচনার পর ওকে গোলকিপিং করতে বলা হল। টুটুল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, ওকে অন্তত বলের পিছনে দৌড়তে হবে না আর বিপক্ষের প্লেয়ারের সঙ্গে চার্জেও যেতে হবে না। খেলা শুরু হল, মাঝে মধ্যে বল টুটুলের কাছেও এল। টুটুল সেই বল ধরে ছুঁড়ে ওদের খেলোয়ারদের পায়ে দিয়ে দিল। প্রথম প্রথম ভীষণ ভয় করছিল, বল ধরতে গিয়ে যদি মিস্ করে তাহলে নির্ঘাত গোল হয়ে যাবে। একবার বল ধরতে গিয়ে হাত থেকে ফসকেও গিয়েছিল, সেবার কোনরকমে আবার বল ধরে অবস্থা সামাল দিয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ খেলা হয়ে গেছে, বিপক্ষ টিমের সন্দীপ ওর ভালো বন্ধু হলেও খেলোয়াড় হিসাবে একটু মারকুটে। ওর পায়ে বল থাকলে কেউ সেই বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে ভয় পায়। টুটুল দেখল সন্দীপ বল নিয়ে দ্রুত ওদের গোলের দিকে ধেয়ে আসছে। টুটুল ভয় পেয়ে গেল, ওর পা থেকে বল কাড়তে গেলে চোট আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ও তাই দাঁড়িয়ে রইল, দেখল সন্দীপ গোলের কাছাকাছি এসে গোল লক্ষ্য করে শট্ নিল। বলটা বেশ জোরেই মেরেছিল, টুটুলের পাশ দিয়ে বল গোলে ঢুকল। টুটুল ভয়ে ভয়ে দুর্বলভাবে হাত দিয়ে অবশ্য বলটা আটকানোর চেষ্টা করেছিল, বল ওর হাতে লেগে গোলে ঢুকল। মাঠে চিৎকার চেঁচামেচি আর নিজের দলের খেলোয়াড়দের গালাগালি শুনতে শুনতে ও মাঠের বাইরে বলটা কুড়িয়ে আনতে গেল। মনের মধ্যে একটা খচখচানি রয়েছে, এই বলটা ও ইচ্ছা করলে আটকাতে পারত।
গোল খাওয়ার পর সবে মিনিট পাঁচেক কেটেছে আবার দেখল সন্দীপের পায়ে বল, দ্রুত গোলের দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ ওর কী হল, মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল সন্দীপের মারকুটে স্বভাবের কথা, দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বলের উপর। সন্দীপ বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল ওকে ওরকম দৌড়ে আসতে দেখে, তাই বলটাকে গোলে মারার চেষ্টাই করতে পারল না। মাঠে হাততালি শুনে টুটুলের ভয় কেটে গেল। জীবনে প্রথম লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বল ধরে বেশ কয়েকটা অব্যর্থ গোল বাঁচালো। ওদের দল এই খেলায় এক শূন্য গোলে হারল ঠিকই কিন্তু, টুটুলের গোলকিপিং সবার ভালো লাগল।
Powered by Froala Editor