ছবি : শুভ্রনীল ঘোষ
|| নায়ক ||
অনির্বাণ রায় সরকার
৷৷ ১ ৷৷
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়েছিল সায়নের৷ আসলে কাল সন্ধ্যায় আর্জেন্টিনা-সৌদি আরব ম্যাচটা দেখার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ নীল-সাদা জার্সির মেসি’রা প্রথম ম্যাচেই হারল৷ এমিলিয়ানো মার্তিনেজ দু-দু’টো গোল হজম করল৷ খেলা শেষে মেসি’র হতাশ মুখটাই অনেক রাত পর্যন্ত কে জাগিয়ে রেখেছিল৷ শুতে শুতে প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিল৷ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবিষ্কার করল বাইরের বেয়াড়া রোদ্দুরের মতো মেজাজটা বেয়াড়া রকম খিঁচড়ে রয়েছে৷ বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল বাবা অফিসে রনা দিলেন৷ তার মানে আজকের খবরের কাগজটা এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে সেন্টার টেবিলে৷ কিন্তু সেটা নিতে আজ আর ইচ্ছে করছে না সায়নের৷ এখন স্কুলে গরমের ছুটি৷ তাই স্কুলে যায়ার তাড়া নেই৷ অনিচ্ছা সত্ত্বে মায়ের বকুনিতে পড়তে বসার তোড়জোর করছিল সে৷ আসলে পড়তে তার মোটেই ভালো লাগে না৷ প্রতিবার রেজাল্ট বেরোলে দেখা যায় সে কোনরকমে ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়েছে৷ অথচ পাশের কোয়ার্টারের বিতান টানা ফার্স্ট হয়েই চলেছে৷ রেজাল্টের দিন সন্ধেবেলা বাবার কাছে বকুনি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে৷ একটাই কথা বাবা বলেন, ‘বিতানকে দেখে শিখতে পারিস না? ওর জন্য ওর বাবা-মায়ের কত গর্ব৷ আর তুই!’ মা বাঁচানোর চেষ্টা করেন৷ বলতে গেলে মায়ের উৎসাহতেই তার ফুটবল খেলা৷ বাবা দু’চক্ষে সহ্য করতে পারেন না তার খেলা৷ অথচ মায়ের কাছে সে গল্প শুনেছে বাবা নাকি এক সময় এই অঞ্চলের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন৷ বাবা কেমন দেখতে দেখতে বদলে গেলেন৷ আসলে বাবার কারখানার অচলাবস্থাই এর জন্য দায়ী৷ এমনটাই শুনেছে সে মায়ের কাছ থেকে৷ তারা যে শিল্প শহরে বাস করে সেই কারখানায় টেলিফোনের তার তৈরি হয়৷ একসময় নাকি খুব রমরমা ছিল এই কারখানার৷ সায়ন অবশ্য সেই সুখের দিন দেখেনি৷ সে একটু বড় হতেই দেখেছে বাবা মাসের পর মাস বেতন পান না৷ মা খুব কষ্ট করেই সংসারটা চালান৷ সে অনেক রাতে পাশের ঘরে বাবা-মায়ের দীর্ঘশ্বাস শুনেছে৷
এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাইরে লান্টুর গলা পেল সায়ন৷ ‘আজ চারটের সময় সরকারদা মাঠে একবার ডেকেছেন৷ তুই তিনদিন ধরে প্র্যাকটিশে আসছিস না৷ তোর ওপর হেবি খচে আছে৷ অবশ্যই যাবি কিন্তু’ আর দাঁড়াল না লাল্টু৷ প্যাডেলে চাপ দিয়ে হুঁশ করে বেরিয়ে গেল৷ না! এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে৷ মনে মনে ভাবল সায়ন৷ আসলে ছাত্র সংঘের সঙ্গে সেদিন জোনাল লিগের ম্যাচটায় শুরুর দশ মিনিটের মধ্যেই একটা বাজে গোল খায়৷ একটা নিরীহ বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে জমা দিয়ে দেয় ওদের স্ট্রাইকারের পায়ে৷ আর চকিতে গোল করে যায় স্ট্রাইকার৷ হাফ টাইমে সবার সামনে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করেছিলেন সরকারদা৷
শুনেছে সরকারদা নিজে একসময় ভালো গোলকিপার ছিলেন৷ এই শিল্পাঞ্চলের ফুটবলে তাঁর খুব সুনাম রয়েছে৷ ফুটবল পাগল বলতে যা বোঝায় লোকটা ঠিক তাই৷ ফুটবলের জন্য বিয়ে পর্যন্ত করেননি৷ চাকরি বাদ দিয়ে বাকি সময়টা মাঠে মাঠেই ঘুরে বেড়ান৷ সম্ভাবনাময় ছেলে দেখলেই তাকে নিয়ে নেমে পড়েন নতুন উদ্যমে৷ ফুটবলাররা তার কাছে নিজের সন্তানের মতো৷ আমরা ছেলেরা ক্লাবে সায়নের আসা তো তাঁরই হাত ধরে৷ তাঁর এই রকম বকুনিতে তাই খুব লেগেছিল সায়নের৷ প্র্যাকটিসে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল সে৷ ব্যাপারটা যে ভালো করেনি সেটা বুঝতে পারল সায়ন৷ আজই বিকেলে প্র্যাকটিসে গিয়ে সরকারদার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে মনে মনে ঠিক করে ফেলল সে৷
৷৷ ২ ৷৷
সায়ন অনুভব করে ফুটবল ছাড়া আর কোন বিষয়ে তার কোন উৎসাহ না থাকা এবং কোনরকমে টেনে টুনে পাস মার্ক জোটানোয় তাকে অধিকাংশ লোকই খুব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে৷ যে ব্যতিক্রমী দু’চারজনের ভালোবাসা সে পায় তার মধ্যে একজন এই সরকারদা৷ এই তো সেদিন কোথা থেকে খবর নিয়ে বেঙ্গল ফুটবল অ্যাকাডেমির ট্রায়ালে সেই খড়দহতে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ অবশ্য মা না থাকলে যাওয়াই হত না সায়নের৷ বাবা তো শুনেই এক কথায় না করে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু মা’র উৎসাহের কাছে হার মানতে হয় বাবাকে৷ ট্রায়ালে অনন্ত স্যারের সামনে তার খেলা দেখার পর ফেরার পথে সরকারদা বলেছিলেন ‘মনে হচ্ছে তোর হয়ে যাবে রে৷’
ইদানীং অবশ্য আর একজনের ভালোবাসা সে অনুভব করে৷ ক্লাস নাইনের চৈতী৷ সে একটা কিছু বলতে চায় বেশ বুঝতে পারে সায়ন৷ কিছু তার কথা শোনা হয়ে ওঠেনি এখন৷ ওর মতো একটা অপদার্থ ছেলেকে চৈতীর মতো মেধাবী ছাত্রীর কি বলার থাকতে পারে? বুঝতে পারে না সায়ন৷ এই তো সেদিন পাড়ার লাল্টুকে দিয়ে প্র্যাকটিশের শেষে দেখা করতে বলেছিল চিল্ড্রেন্স পার্কের গেটটার সামনে৷ সেটা ছাত্র সংঘ ম্যাচের আগের দিনের কথা৷ কিন্তু সরকারদা টিম মিটিং করায় তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷ পরে পানের দোকানের নির্মলের মুখে শুনেছিল বহুক্ষণ অপেক্ষার পর সন্ধের অন্ধকার নামতেই মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিল৷ চৈতী৷ এলাকায় মেধাবী ছাত্রীর সুনামের পাশাপাশি গানের জন্য বেশ সুনাম রয়েছে চৈতীর৷ শুধু এই শহর কেন পাশের রূপনারায়ণপুর, চিত্তরঞ্জন ছাড়িয়ে আসানসোল পর্যন্ত বিভিন্ন কম্পিটিশনে ফার্স্ট প্রাইজটা তার বাঁধা৷ তার বাবা সত্যেন কাকু এই কোম্পানির অফিসার৷ অত্যন্ত রাশভারী মানুষ৷ একদিনই বাবা একটা জরুরি কাগজ পাঠিয়েছিলেন সায়নের হাত দিয়ে৷ ওদের বাংলোয় গিয়ে সাজানো ঘর দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল সায়ন৷ সেই বাড়ির মেয়েকে শুধু তার খেলায় নয়, প্রাকটিসে অনেক দিন মাঠের পাশে ঘুরতে দেখেছে সে৷ একদিন মা’কে কথাটা বলতে হবে ভেবেছে সায়ন৷ মা শুধু তার মা-ই নয়, বন্ধু বটে৷
৷৷ ৩ ৷৷
ঘডির কাঁটা চারটে ছুঁই ছুঁই হতেই সায়ন পা বাড়াল মাঠের দিকে৷ গিয়ে গিয়ে দেখে তখন অধিকাংশ ছেলে এসে পৌঁছায়নি৷ সরকারদা মাঠের পাশে বড় বট গাছটার নিচে মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছিলেন৷ ওকে দেখেই মাথা উঁচু করে বললেন, ‘বোস কথা আছে’৷ আশ্চর্য শান্ত স্বরে কথা বলছেন সরকারদা৷ ‘এই যে তোকে সেদিন বকাবকি করলাম, সে কি আমার জন্য? তোকে ক্লাবে নেওয়ার জন্য, তারপরে দিলুকে বসিয়ে তোকে খেলাবার জন্য আমাকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে৷ আর তুই! দেখ, তোরা ছাড়া আমার তো কেউ নেই৷ আমার পর চাপ রয়েছে পরের ম্যাচে তোকে বসিয়ে দিলুকে খেলানোর জন্য৷ কিন্তু আমি তোকেই খেলাব৷’ গলাটা ধরে এলো সরকারদার৷ হঠাৎ সায়ন অনুভব করল তার চোখে জল৷ সরকারদা বলে উঠলেন, ‘কিরে তুই কাঁদছিস৷ তুই না স্পোর্টসম্যান! শুনে রাখ স্পোর্টসম্যানরা কোন দিন কাঁদে না৷ চোখের জলটাকে আগুন কর৷ মনে রাখ পেনাল্টি বক্সটা তোর জমিদারি৷ ওখানে তুই কাউকে রেয়াত করবি না৷’ সায়নের চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল৷
৷৷ ৪ ৷৷
এক একটা দিন কেমন যেন অন্যরকম৷ সেদিন যা করা যায় তাই-ই ঠিক হয়৷ এই যেমন আজ৷ বিকেল চারটে-এ চিত্তরঞ্জনের ওভাল মাঠে সবুজ মেলার বিরুদ্ধে ম্যাচ৷ এই ম্যাচটা সায়নের কাছে খুব গুরুত্বর্পূ৷ সকাল থেকেই মনোসংযোগের চেষ্টা করে চলেছে সে৷ একটু আগেই জানালার পাশে লাল্টুর গলা পেল সায়ন৷ মুখ বাড়াতেই লাল্টু মুখে কিছু না বলে একটা ছোট্ট চিরকুট বাড়িয়ে দিল৷ আগ্রহ নিয়ে খুলতেই, ‘আজ ভালো খেলা চাই৷’ শুধুই এটুকু লেখা৷ নিচে কারোর নাম নেই৷ তবু সায়নের বুঝতে কোন অসুবিধা হল না লেখাটি কার৷ এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল সারা শরীরে৷
ঠিক দুটোয় ক্লাবের সমীরদা তাকে নিতে এল৷ সমীরদার বাইকের পিছনে চেপে মাঠে পৌঁছাতেই দেখল উদভ্রান্তের মতো সরকারদা ঘোরাঘুরি করছেন৷ ওর মুখোমুখি হতেই মাথা নিচু করে বললেন, ‘না রে! তোকে এই ম্যাচটায় খেলানো গেল না৷ দিলুই খেলবে৷ তবু তুই হাল ছাড়িস না৷’ কথাটা প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল সায়নের কানে৷ চোখের সামনে দেখল টিম নামছে মাঠে৷ সবার আগে হলুদ রঙের ফুলহাতা জার্সিতে দিলু৷ অনিচ্ছা সত্ত্বে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চে নির্দিষ্ট জায়গায় বসল৷ হাফ টাইমের ঠিক আগে একটি বিশ্রী গোল খেয়ে বসল দিলু৷ শুধু গোল খাওয়াই নয়, দিলুকে আজ দেখে প্রচণ্ড নার্ভাস মনে হচ্ছে৷ আর দুটি গোল খাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিল দিলু৷ বিরতিতে ড্রেসিংরুমে ছোটখাটো জটলা৷ কর্তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে প্রায় জেদ করেই সায়নকে তৈরি হতে বললেন সরকারদা৷
সেকেন্ড হাফে মাঠে নামার পরে গোল পোস্ট প্রণাম করতে গিয়েই চোখ পড়ল গ্যালারির দিকে৷ গ্যালারির এক কোণে বসে আছে চৈতী৷ একবার মৃদু হাত নাড়ল সেখান থেকেই৷ দেখেও দেখল না সায়ন৷ এরপরেই চোখ বন্ধ করতেই প্রণাম করতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের ছবি৷ আজ তাকে অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে৷ তারপর গোটা গ্যালারি হতবাক হয়ে দেখছে সবুজ মেলার সঙ্গে খেলা হচ্ছে শুধু সায়নের৷ একের পর এক ঢেউয়ের মতো সবুজ মেলার আক্রমণ আছড়ে পড়ছে তাদের পেনাল্টি বক্সে৷ সায়ন একক দক্ষতায় সেগুলো অবলীলায় প্রতিহত করে চলেছে৷ এর মধ্যেই কাউন্টার অ্যাটাকে একটি গোল পেয়ে গেল তারা৷ আবার সেই দিপুদা৷ দিপু ছেত্রী৷ তাদের দলের নেপালী স্ট্রাইকার৷ ওদের কাছে শ্যাম থাপা হিসেব পরিচিত৷ সায়নের সঙ্গে এত অল্পদিন মধ্যেই খুবই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। গোল করার পর করার পর নিচে নেমে এসে দিপুদা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমার কাজ করে দিয়েছি, এবার তুই দেখ যেন আর গোল না খাই৷ চালিয়ে যা বস’ খেলার শেষদিকে সবুজ মেলার পরের পর আক্রমণের সামনে দিশেহারা হয়ে ওদের ডিফেন্সের চন্দনদা মেরে বন্ধ সবুজ মেলার কৃশানুকে৷ তা আবার পেনাল্টি বক্সের মধ্যেই৷ ঘডির কাঁটা বলছে খেলা শেষ হতে আর বড় জোর মিনিট দু’য়েক৷ সারা মাঠ চুপচাপ৷ পজিশন নিতে নিতে সায়নের চোখ গেল গ্যালারির সেই কোণে৷ যেখানে তখন ছায়া নেমেছে চৈতীর মুখে৷ এক লহমায় সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েই চোখ বুজল সায়ন৷ মা’র মুখটা মনে করার চেষ্টা করল সে৷ রেফারির বাঁশির পর একটা চমৎকার রিফ্লেক্সে স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে যাওয়াটাই মনে আছে তার৷ বাকিটা গ্যালারির উচ্ছ্বাসে বুঝতে পারল পেনাল্টিটা বাঁচিয়ে দিয়েছে সে৷ তারপরেই রেফারির দীর্ঘ বাঁশি৷
তাকে কাঁধে নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাঝেই চোখ গেল চৈতীর দিকে৷ ভিড় থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সে৷ যেন কিছু বলতে চায়৷ কিন্তু সমর্থকদের ভিড় আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল সায়নকে৷
৷৷ ৫ ৷৷
সন্ধে সাডে সাতটা৷ সায়ন এখন নিউমার্কেটে৷ রতনদার মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে৷ খেলা শেষের পর তাকে ঘিরে জটলার মাঝে কোনও এক উৎসাহী সমর্থক তার হাতে গুঁজে দিয়েছে একটি পাঁচশো টাকার নোট৷ সায়ন তাই মা’র জন্য মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরবে৷ দোকানের সামনে তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন রতনদা, ‘আয় আয়, তুই তো আজ হিরো রে৷’ কাঁচা-পাকা চুলের মাঝবয়সি রতনদা ফুটবল ভক্ত৷ খেলা থাকলেই দোকান কর্মচারীদের হাতে ছেডে দিয়ে চলে যান মাঠে৷ যেমন আজ গিয়েছিলেন৷ রতন উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেন, ‘আজ তোর বাবার জ্বালা জুড়োলো৷’ কথাটা শুনেই নড়ে চড়ে বসল সায়ন৷ এই একটি বিষয় ছোট থেকে তার অজানাই থেকে গেছে৷ কেউ এমনকি মা’ তাকে এই বিষয়ে কিছু বলেননি৷ তার বাবা নিজে ফুটবলার হলে ফুটবলের প্রতি তার এত রাগ কেন?
রতনদাকে চেপে ধরতেই যা শুনল তা হল, তার বাবা এই অঞ্চলেরই এক নামী ক্লাব নেতাজি স্পোর্টিং-এর স্ট্রাইকার ছিলেন৷ জেলা দলে ডাক পেয়েছিলেন৷ প্রায় কুড়ি বছর আগে এখানকার আর এন ভট্টাচার্য মেমোরিয়াল শিল্ডে প্রায় একার দক্ষতায় দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন তিনি৷ সেমিফাইনালে কলকাতার কোনও ক্লাবের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক ছিল তাঁর৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে ফাইনালে বিহারের এক কোলিয়ারির দলের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই চূড়ান্ত অফ ফর্মে ছিলেন তিনি৷ চারটে সহজ সুযোগ নষ্ট করেন তার বাবা৷ শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হারে নেতাজি স্পোর্টিং৷ খেলা শেষে সমর্থকরা গালিগালাজ করতে থাকে তাঁকে ঘিরে৷ এমনকী চড়-চাপড়ও পড়ে তাঁর ওপর৷ রটনা হয় ঘুষ খেয়েছে শম্ভু মানে তার বাবা৷ ক্লাব কর্তারা নীরব থেকে সম্মতি জানায় এই রটনায়৷ কেউ জানত না ম্যাচ শুরু হওয়ার ঘন্টা দেড়েক আগে শম্ভুর কানে পৌঁছে ছিল ছেলেবেলায় তাঁকে মানুষ করা মাসি তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন৷ চূড়ান্ত অপমানে, দুঃখে বাড়ি ফিরে ফুটবলের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দেন তার বাবা৷ কথাটা শুনে গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল সায়নের৷ এই প্রথমবার বাবার জন্য কষ্ট হল তার৷
রতনদার দোকান থেকে বেরতেই মুখোমুখি দেখা নির্মলকাকু, সুনন্দা মাসির সঙ্গে৷ এই দম্পতিকে খুবই ভালে লাগে ওর৷ সুনন্দা মাসি মায়ের চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট হলে মা’র খুব প্রিয় বান্ধবী৷ মায়ের অনুরোধেই ইঞ্জিনিয়ার নির্মলকাকু ক্লাস এইটের পরীক্ষার আগে মাস খানেক অঙ্কটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন৷ বলা যেতে পারে তাঁর দৌলতেই এইটের গণ্ডিটা উতরোতে পেরেছিল সে৷ নির্মলকাকু সে সময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘এদেশের অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি আর বাইচুং ভুটিয়া, সুনীল ছেত্রীদের প্রয়োজন রয়েছে৷ সেটা এদেশ আর কবে বুঝবে! ওদের কানে আজকের ম্যাচের খবরটা পৌঁছেছে৷ নির্মলকাকু পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘ফুটবলটা চালিয়ে যাও৷ কোন চাপের মুখে ছেড়ো না৷ তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা সবার থাকে না৷’ সুনন্দা মাসি বললেন, ‘এই ওকে ছেড়ে দা তো৷ তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা৷ গৌরীদি নিশ্চয়ই তোর অপেক্ষায়...৷’ কথাটা চাপা পড়ে গেল সমবেত একটা চিৎকারে৷ সম্বিৎ ফিরতেই সায়ন মুখ ফিরিয়ে দেখল, মায়ের হাত ছেড়ে সুনন্দা মাসির একমাত্র ছেলে বছর চারেকের টুবলু সোজা বাস রাস্তার ওপর৷ ওদিকে তখন ৭.০৫-এর সুরধ্বনি গতি বাড়িয়ে চলেছে আসানসোলের দিকে৷ এই বাসটা এখানে দাঁড়ায় না৷ মুহূর্তে ঘণ্টা দেড়েক আগের মাঠের সেই পেনাল্টি বাঁচানোর রিফ্লেক্স৷ স্প্রিং-এর মতো ছিটকে যাওয়া সায়নের৷ কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে উপস্থিত সকলে চোখ খুলে দেখে সায়নের বাড়ানো হাতের নিরাপদ আশ্রয়ে টুবলু৷ সুরধ্বনি তখন বেশ কিছুটা দূরে আওয়াজ তুলে থেমে গিয়েছে৷
৷৷ ৬ ৷৷
এখন রাত সাডে আটটা৷ শীতের রাতে এই ছোট্ট শিল্প শহরটাকে কেমন যেন মায়াবী লাগে৷ আধো-কুয়াশায় আচ্ছন্ন শহরটাকে বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে করে সায়নের৷ সেই রকমই শীতের রাতে সায়নদের কোয়ার্টার্সে এখন একটা ছোটখোটো জটলা৷ পাড়া প্রতিবেশী কে নেই সেখানে? ওদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক শান্তিময় স্যার এসেছেন৷ উপস্থিত সত্যেন কাকু৷ আর এক কোণে মা-বাবার সঙ্গে ছোট্ট টুবলু৷ সন্ধ্যের ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে নিশ্চুপ৷ মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে সবাইকে চা এগিয়ে দিচ্ছে চৈতী৷ ঠিক যেন ঘরের মেয়ে৷ তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েই লাজুক ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিল আজ৷ শান্তিময়বাবু ধর্মভীরু মানুষ৷ বললেন, ‘তুই তো আমাদের গর্ব৷ আজ তুই সাক্ষাৎ যমের নেওয়া পেনাল্টি বাঁচিয়ে দিলি৷’
বড হওয়ার পর থেকে এই প্রথম বাবার মুখে খুশির ঝিলিক দেখল সায়ন৷ চোখটা যেন একটু চিক চিক করছে বাবার৷ বাবা কি কাঁদছেন? বাবাকে ওইরকম দেখে তার চোখ ভিজে গেছে কখন বুঝতে পারেনি সায়ন৷ চোখের জলের স্বাদ যে এত মিষ্টি হয় আজ প্রথম অনুভব করল সে৷
Powered by Froala Editor