Search

Suggested keywords:

রামধনুর সাতরঙ ফুটবল

রামধনুর সাতরঙ ফুটবল

জাস্ট শাট আপ আকাশ, ডোন্ট এন্টারটেন দেম এট অল। মৈত্রী, তুমি কিন্তু ফালতু রাগ করছ! হোয়াট ফালতু আকাশ? তোমার বন্ধু দিনের পর দিন আমাদের এই তিন কামরার ফ্ল্যাটে পড়ে থাকবে। কেশবের মতো এ পাড়ার টপক্লাস ভ্যাগাবন্ডরা এখানে এসে বিকেলবেলা ফুটবল নিয়ে আড্ডা জমাবে, টুবুনের লেখাপড়া হ্যাম্পার্ড হবে, অথচ আমাদের ন্যাকা যুধিষ্ঠির সেজে থাকতে হবে। কিচ্ছু বলা চলবে না।

তুমি কিন্তু সুদীপের ব্যাপারটা নিয়ে অতিরিক্তই রি-অ্যাক্ট করছ। কালকেই তো বললাম, ও আর কয়েক দিনের মধ্যেই চলে যাবে।

থাক চলে যাবে এ বাড়িতে দু'বেলা ভালোমন্দ খাওয়ার মস্তি। তোমার বন্ধু এখন দারুণভাবেই এনজয় করছে। সুদীপ এত নিশ্চিত জীবন ছেড়ে এখান থেকে সহজে যাবে না।

আস্তে, বল, ও চলে এলে কথাগুলো শুনতে পাবে।

এসব কথা শুনে, ওদের গায়ে কোনও আঁচ লাগে না আকাশ। প্যারাসাইটরা কোনও দিনও সেল্ফ রেসপেক্ট নিয়ে, বট গাছের মতো আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করতে পারে না। তাই তোমার বন্ধু আমাদের কথা শুনে ফেললেও এখান থেকে সহজে নড়বে না।

সুদীপ কিন্তু প্যারাসাইট নয় মৈত্রী, ও একজন প্রমিসিং ফুটবল কোচ। 

রিয়েলি? এই চৌত্রিশ বছর বয়সে কোন বড় দলের কোচ তোমার বন্ধু? ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান নিদেনপক্ষে চিরাগ ইউনাইটেড?

ব্যাপারাটকে হালকা করার জন্য আকাশ বলল, তুমি তো দেখছি ফুটবল নিয়ে বেশ ভালোই ইনফো রাখ গুরু। অথচ আমাদের দেশের সুন্দরীদের এখন প্রধান আকর্ষণের বিষয়ই হল ক্রিকেট।

ভুলে যেওনা আকাশ। আমি হলাম হাটতলার বোস পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা জুনিয়ার লেভেলে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দীর্ঘদিন ফুটবল খেলেছেন। আমার মাসতুতো দাদার নাম তো এখন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে প্রায় সবাই-ই জানে। সে আমি যে আর পাঁচটা হাউসওয়াইয়েদার মতো মৈত্র ব্যা ব্যা ব্ল‍্যাক শিপ হব না। আশাকরি এই বুঝতে তোমার নিশ্চয় বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না।

তা আর বলতে, এটা আমি প্রতিদিন প্রতি রাতে বুঝি যে, আমার বউ হল সুপার কপ।

মৈত্রী একটু হেসে বলল, দিনের বেলা আমি অবশ্যই সুপার কপ। রাতের বেলা তুমিও কিন্তু ভালো যোদ্ধা আকাশ। তখন তোমায় দেখে কে বলবে, এই মানুষটাই  দিনের বেলা কত শান্ত, ভদ্র, নম্র রুচিশীল। সফটিসফটি চেহারা নিয়ে থাকে

বউ এর মুখে নিজের পৌরুষের প্রশংসা শুনে মনে বেশ আরাম লাগে আকাশের। ও আস্তে করে বলে, তোমার মতো বউ পেলে না, আলিবর্দি খাঁ সাহেবের আমলের মৃত সৈনিকও ঠিক আকাশে ঘুড়ি ওড়ার ফেলবে।

 

।। দুই।।

রান্নাঘরে গ্যাস জ্বালিয়ে আকাশ,  আগুনের শিখার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেও ভাবে আগুনের শিখার ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। আগুনের যাবতীয় ক্ষমতা এই শিকার ভেতেরও থেকে। অথচ শিখা মাএনই পুরো আগুন হয়।  অআকাশ মনে মনে নিজেকে বলে জীবনে সফল হওয়ার জন্য আগুনের শিখা হয়ে লাভ নেই, টোটাল আগুনের শিখা হয়ে লাভ নেই, টোটাল আগুন হতে হবে। না হলে ব্যাঙও ফাউল করবে। সুদীপের মতো দশা হবে।

চায়ের জলে চিনি ফেলতে ফেলত আকাশ ভাবে, মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে ওর যে এই সাফল্য। তার জন্য দায়ী একান্তভাবেই ওর পজিটিভ থিংকিং। কোম্পানির ওপর মহল মনে করে আকাশ পারবেনা এমন কোনও কাজ নেই। মৈত্রী একে মিস্টার ডিপেনডেবল ভাবে।  টুবুন এই বয়সেই ভাবে,  ওর বাপি হল দ্য বেস্ট। 

অথচ আকাশ জানে সুদীপ, তনুময় এদের প্রসপেক্ট একসময় ওর চেয়ে অনেক অনেক বেশি ব্রাইট ছিল। তনুময় শুধু মৈত্রীকে না পাওয়ার ফ্রাসট্রেশনে মদ খেয়ে খেয়ে নিজের গোল্ডেন ইয়ারগুলো শেষ করে দিল, না হলে তনুময় আজ বিরাট হেত পারত। ওর জ্ঞানকে প্রফেসাররা পর্যন্ত সমীহ করত। আর কলেজ লাইফের প্রথম দু’বছর তো মৈত্রী তনুময়ের ওপরই ফিদা ছিল। তখন আকাশকে মৈত্রী ওর কাছে ঘেঁষতে পর্যন্ত দিত না।

তারপর মৈত্রী ঠিক বুঝতে পারল, তনুময় ভালো কবিতা লিখতে পারলেও  কলেজে টপ রেজাল্ট কিন্তু করবে সেই প্রকাশ। ফলে মৈত্রী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগল আকাশের দিকে। 

আর মৈত্রীর আকর্ষণকে এড়ানোর ক্ষমতা আর যার হোক আকাশের ছিল না। আকাশ নিজেকে মনে মনে গাল দিয়েই বলল, শালা পুরুষ জাতটাই হল সার্কাসের পোষা হাতির মতো। যাকে সারাজীবন সার্কাসের ব্যবসার জন্য বন্দী করে রাখা হেব। সে নিয়ম মেনে প্রতিদিন খেলা দেখাবে আর মাহুতের ভালবাসা পেলে নিজেকে জন্য মনে করবে। আকাশ ভাবে বিয়ের পাঁচ বছর পরও মৈত্রী নামক মাহুতের একটু ভালোবাসা পেলেই ও আজও  ভুলে যায় জীবনের সমস্ত হতাশার কথা।

তবে সুদীপকে দেখে এখন ভীষণ কষ্ট হয় আকাশের। আবার মাঝে মাঝে সুদীপের বর্তমান দশা দেখে আনন্দও পায় আকাশ। ক্লাস টুয়েলভে ওদের স্কুলের হিরো ছিল সুদীপ। স্কুলের তারা স্যার বলতেন, সুদীপ যেমন শেষের কবিতার মানে ব্যাখ্যা করতে পারে, তেমনি ও গ্যারিঞ্চার মতো। ভেসে গিয়ে হেড দিয়ে চমৎকার গোলও করতে পারে।

সেই সময় আকাশ ইন্টারস্কুল ক্যুইজে ওদের স্কুলকে প্রাইজ এনে দিলেও সবাই বলত সুদীপের কথা।

সে সময় হিংসেয় জ্বলে যেত আকাশ। মনে হত, হেঁসোর দু'কোপে যদি সুদীপের পা দুটো কেটে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা যায়। তবে মনে হয় জীবনে শান্তি আসবে। কাউকে মেরে ফেলার প্রচেষ্টার ভাবনার ভেতরেও যে এত আনন্দ লুকিয়ে থাকতে পারে। তা ওই বয়সেই প্রথম অনুভব করেছিল আকাশ।

ওরা যখন কলেজে ঢুকল। সেই সময় সুদীপ কলকাতার একটা বড় ক্লাবে খেলছে আকাশে বাতাসে সেই সময় সুদীপের হালকা করে হলেও প্রশংসা ভাসছে। এমনি সময় ওর বা পায়ের মালাই চাকির হাড় ভেঙ্গে গেল। ওর মালাই চাকিতে কৃত্রিম প্লেট বসান হল। এরপর সুদীপের বাবাও মারা গেলেন। সবাই ভাবল ফুটবলার সুদীপ শেষ। 

চোট সারার পর বন্ধুরা, সুদীপের ভেতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল। ও ঘোষণা করল, ‘ময়দানে আমি আর ফেরত যাব না। আমি কোচিং শুরু করব।’ সুদীপের এই মনোবাসনা জানার পর, আকাশ বুঝেই গিয়েছিল, হি ইজ ফিনিশড নাও। 

এবং বাস্তবে হয়েছে তাই। গত দশ বছরে ওরই ব্যাচ মেট আকাশ, কুশলরা লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি করেছে। বাট সুদীপ সেই পড়ে রয়েছে ওর গ্রামে। ওখানে ও একটা ফুটবল অ্যাকাডেমি ঢালায়। সুদীপ নিজেই বলে, 'আমাদের অ্যাকাডেমির সব কিছুই রয়েছে। শুধু 'পয়সাটা যা নেই।'

ও কলকাতায় এলেই আকাশকে ধরে স্পনসর যোগাড় করে দেওয়ার জন্য। তখন ওর নিজেরই খুব হাসি পায়। কেননা আকাশ জানে কর্পোরেট সেক্টরের চোখে এই মুহূর্তে গ্রামীণ ফুটবলের তেমন কোনও দর নেই। বাইচুং-এর ওপর লগ্নি করলে ফিডব্যাক পাওয়া যাবে কিন্তু এই মুহূর্তে শতাংশও পাওয়া যাবে না এই মুহূর্তে গ্রামের কোনও অখ্যাত ফুটবল অ্যাকাডেমির ওপর টাকা লগ্নি করলে।

আকাশ জানে সুদীপের যা ইনটালেক্ট লেবেল তাতে ওর কাছেও এই বিষয়টা জলের মতোই পরিষ্কার। তবু নাছোড় যোদ্ধার মতোই ও তার অ্যাকাডেমির জন্য স্পনসর যোগাড় করতে চায় তবে সুদীপের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে কথা বললে আকাশ মনে মনে দারুণ একটা রিফ্রেসমেন্ট পায়। 

নিজের কোচিং জীবন শুরু করা প্রসঙ্গে, সুদীপ বলে, জানিস ছোটবেলা থেকেই আমার বাবার ডান পা-টা একটু ডিফেকটিভ ছিল। মানুষটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতো। ছোটবেলায় বাবাকে সবাই প্যাঁক দিত--দেখ দেখ ল্যাংড়া আম নাচতে নাচতে আসছে ফুটবলে লাথি মারবে বলে। গ্রামের মাঠে ছোটরা দস্যিপনায় তুফান তুলে খেলত ফুটবল। আর বাবা জুল জুল চোখ করে দেখত সেই খেলা। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। ওনার পায়ের সমস্যার জন্য। তবু লোকটা ফুটবলের সঙ্গ ছাড়তো না। এমনকি স্ট্রোকে মারা যাবার দু'দিন আগেও বাবা উত্তরপাড়ার মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিল।

বাবার বন্ধু লক্ষ্মণকাকু বলেছিলো, লোকটা মৃত্যুর দু'দিন আগেও আমাদের গ্রামের টিমের জন্য রীতিমত লক্ষ কম্প করেছিলেন উত্তরপাড়ার মাঠে।

আকাশের স্পষ্ট মনে পড়ে সুদীপ বলেছিল, জানিস বাবার মৃত্যুর পরই, আমার মনে হয়েছিল আমি এবার ফুটবলকে সত্যিকারের বুঝতে পারলাম। ফুটবলের ক্ষমতা ঠিক পাহাড়ি ঝর্ণার মতো। কোনও অন্ধ যেমন জীবনে পাহাড়ি ঝর্ণা না দেখলেও তার মনে যেমন কোনও না কোনও পাহাড়ি ঝর্ণার ছবি ঠিক গুছিয়ে বসে থাকে। প্রায় তেমনি আমার বাবা জীবনে ফুটবল না খেললেও সকার নামক পাহাড়ি ঝর্ণার রূপে মুগ্ধ হয়েছিল।

আর বাবার মুগ্ধতার জোর এতটাই ছিল যে, বাবাও আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিল সেই ফুটবলেরই একটা শক্তি। ওর মৃত্যুর পর, আমাদের ক্লাবের সমস্ত খেলোয়াড় ওর জন্য অঝোর নয়নে কেঁদেছিল। তখন আমি জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম অন্তরালে থাকলেও  ফুটবল খেলার মাঠে শক্তি হওয়া যায়। আর কোচ হলেন সেই শক্তিরই সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ফোরণ।

আকাশের মনে পড়ে সুদীপ বলত, জানি পা ভাঙার পর বুঝতে পারলাম, এই  ভাঙা দুর্গের মতো পা নিয়ে আর যাই হোক সর্বোচ্চ লেভেলে পারফর্ম করতে পারব না। তখনই ঠিক করলাম, আমিও বাবার মতো ফুটবলের অন্তরালের শক্তি হব। বাবার চেয়েও ফুটবলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও দিলচস্ত হবে। কোচ হব। গ্রাম থেকে নতুন নতুন প্লেয়ার তৈরি করব যারা শহরে গিয়ে চিৎকার করে বলবে, কাম অন কিল মি. আই অ্যাম আ ফুটবলার।

সুদীপের একথা শুনেআকাশ বলেছিল, সফল খেলোয়াড়ের ব্র্যান্ডনেম ছাড়া কি কোচিং আমাদের দেশে খুব একটা প্রফেশন? পদ্মপাতায় জমে থাকা জলের মতো মানুষের কেরিয়ার হতে পারে না। যা একটু ধাক্কা খেলেই টস করে মাটিতে পড়ে যাবে।

রান্নাঘরের আলোর বন্যায় সুদীপ স্পষ্ট অতীতকে দেখতে পেল। আকাশের এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সুদীপ সেদিন স্মিত হেসেছিল।

 

(তিন)

হঠাৎ-ই বাড়িতে একটা টেনশন তৈরি হয়ে গেল। মৈত্রী টুবুনকে আঁকার স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে এলাহি জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরল। দুটো বড় কোকের বোতল, একগাদা কেক, পেস্ট্রি, চানাচুরের প্যাকেট। 

মৈত্রীর মুখে এখন গর্বের আলো যেন উজ্জ্বল চাঁদের মতোই জ্বল জ্বল করছে। মৈত্রী বলল, জান কিশোরদা আমাদের বাড়িতে উইথ ক্যামেরা আসবেন।

কিশোরদা মানে, তোমার ওই ক্রীড়া সাংবাদিক মাসতুতো দাদা! যার বিখ্যাত বইয়ের নাম হল, 'সর্দি কাশি ও ক্রিকেট' যেখানে উনি বিদেশ সফরে গিয়ে কোন কোন ভারতীয় খেলোয়াড় কীভাবে সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তা ওনার মতো এত ট্রিমেন্ডার্স ব্যক্তিত্বের পদধূলি হঠাৎ আমাদের বাড়িতে।

কিশোরদা সুদীপদার একটা ইন্টারভিউ নেবে। যা আগামী শনিবার ওদের চ্যানেলের ফুটবল কথা অনুষ্ঠানে দেখানো হবে। তোমার মোবাইলটা তো আমি নিয়ে

গিয়েছিলাম। আর সুদীপদা তোমার নম্বরটাই ওর কন্টাক্ট নাম্বার হিসাবে সবাইকে দিয়েছে। কিশোরদা আমায় ফোন করে বলল, সুদীপদার জমা দেওয়া গ্রামীণ ফুটবলের ওপর একটা প্রজেক্ট এক বিদেশি কোচের ভালো লেগেছে। ওই কোচ ইন্টারনেটে তার লেখায়, সুদীপের খুব প্রশংসা করেছেন। 

খোয়াই কিশোরদা চাইছে, ওর একটা ইন্টারভিউ ইমিডিয়েট নিয়ে নিতে।

আকাশ মনে মনে বলল, টিভি ক্যামরোর কি মহিমা। যে মৈত্রী দু'ঘন্টা আগেও বলেছিল তোমার বন্ধু তার মুখেও এখন সুদীপের নাম হয়েছে সুদীপদা।

মৈত্রী এখন এক এক করে টুবুনের বন্ধুদের মায়েদের খবর দিচ্ছে ওদের ফ্ল্যাটে আসার জন্য। কেন না সাড়ে আটটার সময় আসার কথা রয়েছে কিশোরদার।

সুদীপ নিশ্চয় এখন কেশবের সঙ্গে রয়েছে। কেশব সুদীপের চেয়ে দশ বছরের ছোট হলেও, ও-ও সুদীপের মতো কোচ হতে চায়।

প্রতিদিন সকালবেলায় কেশব বিনে পয়সায় সরশুনার বিভিন্ন মাঠে কচিকাঁচাদের ফুটবলের ট্রেনিং দেয়। ও বলে বাঙালির ছেলেরা এখন মাঠে দৌড়তে ভুলে গিয়েছে। তাই ফুটবল মাঠে বাচ্ছাদের দৌড় দেখলে বিন্দাস লাগে। তখন মনে হয় বল পায়ে এক একটা দেব শিশু যেন দৌড়ে চলেছে, গোটা ফুটবল বিশ্বকে এই মুহূর্তে কব্জা করবে বলে।

আকাশ ভাবে ভাগ্যিস ও কেশব, সুদীপের মতো হয়নি। তাই জন্যই ও জীবনে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। আকাশ ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস করত যে, চেনা ছকের বাইরে গিয়ে জীবনে সফল হওয়া যায় না। চেনা ছকে থাক। ভালো রেজাল্ট কর। কর্মজগতে গিয়ে ওপরওয়ালাকে তেলাও। পরিশ্রম কর। নিখুঁত পরিকল্পনা রাখ, দেখবে সাফল্য তোমার বাঁয়ে হাত-কা খেল হবে।

অথচ সুদীপ সেই কিশোর বয়স মানুষকে খুন করে যা পারেনি। মারাদোনা, পেলে কাউকে খুন না করেই সেটা পেরে গেছে। এদের মানুষ হিটলারের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি ভালবাসে। তাই আমি মনে করি, একজন সফল চাকরীজীবির

চেয়ে একজন সি গ্রেড ফুটবলার অনেক বেশি সম্মানীয়।

আকাশকে ফোন করে ব্যাপারটা জানানোর পর থেকেই সুদীপের প্রতি আকাশের পুরোনো  হিংসাটা আবার ফেরত এল। গত কয়েক বছরে সুদীপকে শুধু করুণাই করেছে আকাশ। এবার ওর মনে হল, আগামী শনিবারের পর থেকে সুদীপও হবে একজন হালকা সেলিব্রিটি। নাম জানবে কয়েক লক্ষ মানুষ। অথচ ও থাকবে সেই মোটামুটি সফল একজন চাকুরীজীবী

 ঘড়ির সময় বলছে রাত দশটা বেজে সবে পনেরোটা বল খেলা হয়েছে। মৈত্রী জ্যাবড়ানো মেঘের মতো মুখ নিয়ে টিভি দেখছে। সুদীপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। টুবুন শুয়ে পড়েছে।

আজ সুদীপের ইন্টারভিউ হয়নি কিশোরদা নিজে ফোন করে এই ব্যাপরে জানিয়েছেন যে, হঠাৎ করে কপিলদেব কলকাতায় চলে আসার ফলে, ওকে এক্ষুনি কিপেলর একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নিতে হবে। যদিও কিশোরদা সুদীপকে বলেছেন, তিন চার দিন বাদে উনি ওদের গ্রামে গিয়েই নেবেন সুদীপের ইন্টারভিউ।

টুবুনের বন্ধুদের মায়ের সামনে, আজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৈত্রীর ইজ্জত। ওরা ভেবেছে মৈত্রী গুল মেরেছে। 

আকাশের এখন এসব ভাবতে একদা ভালো লাগছে না।

ওর ছোটবেলায় দেখা এক সন্ন্যাসীরা কথা এখন খুব মনে পড়েছে। চড়কের মেলায়ও দেখেছিল, এক সন্ন্যাসী নিজের কাঁধে কাঁটা বিঁধিয়ে চড়ক গাছকে জড়িয়ে ধরছে। এবং তাকে মই-এ তুলে শূন্যে ঘোরানো হচ্ছে। ছোটবেলায় অনেকদিন পর্যন্ত ওই সন্ন্যাসীই ছিল আকাশের আইডল। 

আকাশের মনে হল, সুদীপ, কেশব এরাও তো ঠিক ওই সন্ন্যাসীর মেতাই বীর। যারা অসংখ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও অসংখ্য মানুষকে খেলাতে চাইছে ফুটবল। ভাবল, এতদিন সুদীপকে অবজ্ঞা অথবা ঈর্ষা করতে গিয়ে বুঝতেই পারেনি যে যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে ফুটবলই। 

আকাশ মনে মনে স্থিরই করে নিল মৈত্রী যতই না বলুক, টুবুনকে কেশবের কাছে পাঠাবেই ফুটবল শিখতে।

Powered by Froala Editor