Search

Suggested keywords:

পিকে

পিকে

'এই খোকা, শোনো।' ভবানীপুর ক্লাবের তাঁবুতে ঢুকতে যাচ্ছিল চন্দন। পিছন থেকে শুনে ও থমকে দাঁড়াল। ঠিক বুঝতে পারল না, কে ওকে ডাকছে। বেলা প্রায় তিনটে বাজে। রাস্তা দিয়ে হুশ করে বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার পশ্চিম দিকে ছুটে যাচ্ছে। ফুটপাতে ও ছাড়া অবশ্য আর কেউ নেই। একমাত্র মা ছাড়া ওকে খোকা বলে কেউ ডাকেনা। এখানে কে ডাকবে? মনের ভ্রম 
 ভেবে চন্দন ফের গেটের দিকে এগোল।

ভাস্করদা বেলা তিনটের মধ্যেই ওকে তাঁবুতে ঢুকে যেতে বলেছিলেন। ভাস্করদা মানে... ভাস্কর ব্যানার্জি। এক সময়ের ময়দান কাঁপানো ফুটবলার। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুটো ক্লাবেই চুটিয়ে খেলেছেন। এখন সেন্ট্রাল এক্সসাইজ ফুটবল টিমের কোচ। চন্দন শুনেছে, খুব কড়া ধরনের মানুষ। প্র্যাকটিসে কোনও প্লেয়ার এক মিনিট দেরিতে এলে, নাকি মাঠ থেকে বের করে দেন। অফিস লিগে খেলার জন্য সেন্ট্রাল এক্সাইজ টিম এবার কয়েকজন নতুন প্লেয়ার নেবে। তাদের ট্রায়াল নেওয়ার দায়িত্বে ভাস্করদা। দু'পা এগোতেই চন্দন ফের স্পষ্ট শুনল, 'এই খোকা, একটু দাঁড়াও না।' বিরক্ত মুখে ঘুরে তাকিয়ে চন্দন দেখল, গাছের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। পরনে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ট্রাক শুট, মাথায় সান ক্যাপ।

তাতে লেখা 'আই অ্যাম দ্য বেস্ট'। শীর্ণ চেহারার মানুষটাকে দেখে ওর ভবঘুরে ছাড়া আর কিছু মনে হল না। মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবে হাসিটা চন্দনের চোখে পড়ল। একটা গজদাঁত আছে। ও জিজ্ঞেস করল, 'আমাকে ডাকছেন?' লোকটা বলল, 'হ্যাঁ' তোমাকেই, এখানে আর কে আছে বলো? অনেকক্ষণ ধরে তোমার জন্যই আমি ওয়েট করছিলাম।'

শুনে চন্দন একটু অবাকই হল। যাঁকে কোনওদিন ও দেখেইনি, তার সঙ্গে কথা বলার মতো সময় এখন ওর নেই। তবুও, বাপের বয়সি মানুষটার সঙ্গে অভদ্রতা করতে ওর মন চাইল না। মা শিখিয়েছে, বড়দের সম্মান করতে। তাই বলল, 'আমাকে আপনি চেনেন?' 'তোমাকে কে না চেনে?' লোকটা এবার কাছে এসে বলল, 'ময়দানে তো তোমার নামই হয়ে গেছে ছোট কৃশানু, তোমার অনেক ম্যাচ আমি দেখিছি। লাস্ট সিজনে ঐক্য সম্মিলনীর হয়ে তুমি চৌত্রিশটা গোল করেছিলে। কি, ঠিক বলছি? তলার ডিভিশনে এই রেকর্ড কোনও ফুটবলারের নেই।' নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে। কিন্তু এসব শোনার মতো সময় ওর হাতে নেই। ঠিক তিনটের সময় টেন্টে না দেখতে পেলে ভাস্করদা হয়তো ট্রায়াল ম্যাচে নামতেই দেবে না। কিন্তু কে এই মানুষটা, এত রেকর্ড রাখে? চন্দন জিজ্ঞেস করল, 'স্যার, আপনার পরিচয়টা জানতে পারি? 'লোকে আমাকে পিকে বলে জানে। আমি ফুটবল রিসার্চার অ্যান্ড অ্যানালিস্ট। একটা সময় কল্পনা করতাম, পেপ গুয়ার্দিওয়ালার মতো কোচ হবো। কিন্তু আমাদের ফুটবল কর্তারা একেকজন কুয়োর ব্যাঙ। নতুন কিছু ভাবনা করার মতো ভিশন তাদের নেই।' এই রে, মানুষটা লেকচার দিতে শুরু করেছেন। রেহাই পাওয়ার জন্য চন্দন বলল, 'স্যার, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। 'জানি। তোমার আজ ট্রায়াল ম্যাচ আছে। এও জানি, ভাস্কর কুড়িজন ইয়াং প্লেয়ারকে আজ ট্রায়ালে ডেকেছে। তোমাদের মধ্যে ছ'জনকে ও চাকরি দেবে। স্ট্রাইকার পজিশনে নেবে মাত্র একজনকে। তুমি জানো কি না জানি না আজ তিনজন স্ট্রাইকারকে ও ট্রায়ালে ডেকেছে। তার মধ্যে তোমার রাইভাল হতে পরে পোর্ট ট্রাস্টের রাজর্ষি। গত সিজনে পোর্টের হয়ে তেরোটা গোল করেছে। ও হায়ার ডিভিশনে খেলে। ওর দিকেই পাল্লা ভারী। কিন্তু তুমি এ সব মাথায় রেখো না। নিজের খেলাটা খেলো। দেখবে, তোমার অসুবিধে হবে না। 'স্যার, আপনি এত খবর পেলেন কোথাথেকে?' 'হ্যাঁ আমি ময়দানেই পড়ে থাকি, জানব না কেন? দেখো, তোমার রাইভাল এসে গেছে।'

ওই সঙ্গে সঙ্গে মোটর বাইকের ভটভট শব্দ শুনতে পেল চন্দন। ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখল, রাজর্ষি বলে ছেলেটা রয়াল এনফিল্ড থেকে নামছে। প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা। ময়দানের বাইরে অনেক টুর্নামেন্টে চন্দন ছেলেটাকে দেখছে। বলতে গেলে মুখ চেনা। হলদিয়া, শিলিগুড়িতে কয়েকটা টুর্নামেন্টে ওর এগেনস্টে খেলেওছে। চন্দন শুনেছে, রাজর্ষি খুব বড়লোক বাড়ির ছেলে। ওর বাবা নামকরা প্রোমোটার। পোশাক আশাকেও বোঝা যায়, রোজ ময়দানে যারা খেলতে আসে, ও তাদের মতো নয়। বাইক থেকে নেমে, চোখাচুখি হতে রাজর্ষি বলল, 'এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চল ভিতরে চল।' চন্দন বলল, 'তুমি যাও। আমি আসছি।' পিকে স্যারের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাজর্ষি ক্লাবের ভিতর ঢুকে গেল। সেটা লক্ষ্য করে উনি বললেন, 'তোমাকে আমি আটকাব না। শোনো, একটা টিপস দিচ্ছি। ভাস্করকে আমি চিনি। ও টোটাল ফুটবলে বিশ্বাস করে। তোমাকে হয়তো আজকের ম্যাচে ও স্ট্রাইকারে খেলাবে না। তোমাকে লেফট ব্যাকে খেলতে বলবে। তুমি কিন্তু গাইগুঁই করবে না। রাজি হয়ে যাবে। তোমার বাঁ পা-টা খুব স্ট্রং। ভাস্কর অবশ্য তোমার ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি দেখবে না। তুমি কতটা অ্যাটাকিং, সেটাই দেখতে চাইবে।' শুনে মুখ শুকিয়ে গেল চন্দনের। পিকে স্যার বলছেনটা কি? ওকে লেফট ব্যাকে খেলতে হবে। ধুত, তা হতে পারে না। তা ছাড়া, ভাস্করদার মনের কথা পিকে স্যার জানলেনই বা কি করে। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ট্রায়ালে ডাকার সময় ভাস্করদা বলেছিলেন, 'তোর কোনও চিন্তা নেই। নর্মাল খেলাটা তুই খেলে যাবি। অফিস টিমের রিক্রুটমেন্ট, বুঝতেই পারছিস। অফিসের বড়কর্তারা ট্রায়াল ম্যাচে থাকবেন। তোর কাজ, গোল করা। তা হলে তোকে নিতে আমার অসুবিধে হবে না।' ভাস্করদা সেদিন এত কথা বললেন। আর এখন লেফট ব্যাকে খেলানোর কথা ভাবছেন। হতে পারে না কি? এই পজিশনে খেললে, ও গোল করবে কি করে? ও কি ব্রাজিলের কালোর্স রবার্তো না কি? এই প্রথম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ল চন্দন।

ওর মুখ দেখে বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছেন পিকে স্যার। হেসে বললেন, 'অত ভাবার কিছু নেই খোকা। কোচেরা মাঝে মাঝে এইসব খ্যাপামি করে। কাজল মুখার্জি অত বড় মিডফিল্ডার। একটা রুমালের মতো জায়গায় অনায়াসে বিপক্ষের তিনটে প্লেয়ারকে কাটাতে পারতেন। কোচ প্রদীপ ব্যানার্জি ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ওকে কোন পজিশনে খেলিয়ে ছিলেন জানো? লেফট ব্যাকে। যাক গে, তুমি ঘাবড়ে যেও না খোকা। অমনভাবে তাকিয়ে আছ কেন? 'স্যার, ওই পজিশনে আমি জিন্দেগিতে খেলেনি।'

'আরে, খেলবে তো ভবানীপুরের এগেনস্টে। এটা কোনও টিম হল। ভাস্কর তোমার কাছ থেকে দেখতে চায়, উইং দিয়ে উঠে, তুমি কি রকম সেন্টার করতে পারো। আর সেই সেন্টার করা বলে রাজর্ষি মাথা ছোঁয়াতে পারে কিনা। অর্থাৎ হেডে গোল করতে পারে কি না? তার মানে চাপ রাজর্ষির উপর। তোমার উপর নয়। যাও, আমার কথাটা মাথায় রেখো। দেখবে, তোমার খারাপ হবে না।

আর কথা না বাড়িয়ে চন্দন তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেওয়াল ঘড়িতে তিনটে বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি। দেখে ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দূরে একটি চেয়ারে বসে আছেন ভাস্করদা। ঘাড়ে একটা তোয়ালে। তাঁবুর ভিতরে মারাত্মক গরম। দরদর করে উনি ঘামছেন। আর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছেন। যারা ট্রায়াল নিতে এসেছে, তাদের অনেককেই চন্দন চেনে না। ওদের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ টেনশনে রয়েছে। অফিস টিমগুলোতে ফুটবলার রিক্রুমেন্ট প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রায় দশ বছর পর সেন্ট্রাল এক্সাইজ এবার নতুন প্লেয়ার নিচ্ছে। একবার সিলেক্টেড হয়ে যেতে পারলে, সেটা লটারির টিকিট পাওয়ার মতো ব্যাপার হবে।

তাঁবুর এই গুমোটের মধ্যে বসে চন্দনের মায়ের কথা মনে পড়ল। মা বোধহয় এতক্ষণে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছে। মা মিড ডে মিল রান্নার কাজ করে বীণাপাণি গার্লস স্কুলে। দুপুর তিনটে থেকে সন্ধে ছটা।.... এই ঘণ্টা তিনেক সময় মা শুধু বিশ্রাম নেওয়ার সময় পায়। তার পর যায় সাহাবাড়ি আর মুখার্জি জেঠুদের বাড়িতে রান্নার কাজ করতে। খুব ছোটবেলায় ওর বয়স যখন দুই-আড়াই বছর, তখন ওর বাবা মারা যায়। তার পর থেকে মা-ই নিজে রোজগার করে ওকে মানুষ করছে। আত্মীয়-স্বজনরা কেউ তখন পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মাকে প্রচুর কষ্ট করতে দেখেছে চন্দন। ফুটবল খেলে যদি একটা চাকরি পায়, তা হলে মাকে আর ও কাজ করতে দেবে না। আজকে ট্রায়াল দিতে আসার আগে, আর্শীবাদ করার সময় মা ওকে শুধু বলেছে, 'এই চাকরিটা পেলে ভাল। না পেলেও ভেঙে পড়িসনা।' ঘড়িতে তিনটের ঘন্টা বাজতেই উঠে দাঁড়িয়ে ভাস্করদা বললেন, 'বয়েজ, গেট রেডি। ফাস্ট ট্রায়াল ম্যাচে যারা ফাস্ট সিক্সটিনে আছ, তাদের নামগুলো আমি বলে যাচ্ছি। আমি নামের সঙ্গে জার্সি নাম্বারগুলো বলে যাচ্ছি। তোমরা একে একে এসে জার্সি নিয়ে যাও।

পাঁচ নম্বর জার্সি দেওয়ার সময় ভাস্করদা ওকে ডেকে বললেন, 'চন্দন, তোকে আজ লেফট ব্যাকে খেলতে হবে। তোর কোনও আপত্তি আছে?

জার্সিটা হাতে নিয়ে চন্দন হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আরে, পিকে স্যার তো তা হলে ঠিকই বলেছিলেন। উত্তরের আশায় ভাস্করদা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন চন্দন জোর করে মুখে হাসি টেনে আনল। স্যার শিখিয়ে দিয়েছিলেন, 'তুমি কিন্তু গাইগুই করবে না। সে কথা মনে পড়ায় ও বাড়তি যোগ করল, 'আমি রাজি স্যার। আমাকে যেখানে খেলাবেন, সেখানেই খেলব।'

ট্রায়াল ম্যাচ খেলে বাড়ি ফেরার সময় চন্দন একবার দাঁড়াল স্টেশনের গায়ে মিষ্টির দোকানের সামনে। সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এই দোকানের হিংয়ের কচুরির খুব নাম দমদম অঞ্চলে। বিকেল থেকে ভিড় লেগেই থাকে। দোকানটার পাশে ওদের স্কুল কুমার আশুতোষ ইন্সটিটিউশন। একটা সময় শেষ পিরিয়ডের দিকে ক্লাসে বসেই চন্দন কচুরি ভাজার গন্ধ পেত। খাওয়ার লোভ হত, কিন্তু কেনার সমার্থ ওর ছিল না। পাড়ার ক্লাবের দেবুদা যখন ট্রেনে করে এ দিক সে দিক হাইটের টুর্নামেন্ট খেলতে নিয়ে যেত, শুধু তখনই ফেরার পথে ওকে নিয়ে সত্যনারায়ণে ঢুকত। আজ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চন্দনের মনে পড়ল, পকেটে দু'শো টাকার একটা নোট আছে। ট্রায়াল ম্যাচের পর ভাস্করদা গাড়িভাড়া দিয়েছিলেন। মা চমচম খেতে খুব ভালবাসে। বাড়িতে নিয়ে গেলে খুব খুশি হবে চমচম কেনার জন্য ও দোকানে ঢুকল। তখনই বোম্পেলদার সঙ্গে ওর দেখা হয়ে গেল। ঐক্য সম্মিলনী ক্লাবের কোচ। চন্দন শুনেছে, খেলার জন্যই রেলে চাকরি পেয়েছিলেন উনি। পঞ্চাশের উপর বয়স। রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় সত্যনারায়ণে ঢুকে, টিফিন সেরে উনি বাড়িতে। ঢোকেন। আজও দোকানের ভিতরে বসে বোম্পেলদা কচুরি খাচ্ছেন। ওকে দেখে ডাকলেন, 'আয় চন্দন। কচুরি খাবি তো বসে যা।' ট্রায়াল ম্যাচের পর ফ্লুরিজের তিনটে স্যান্ডউইচ খেয়ে এসেছে চন্দন। পেটে আর জায়গা নেই। ও বলল, 'আজ থাক স্যার। খানিক আগেই টিফিন করেছি।'

'তোর ট্রায়াল কেমন হল রে? গোল পেলি?'

চন্দন বলল, 'একটা পেয়েছি। ফ্রিকিক থেকে। ম্যাচটা আমরা চার গোলে জিতেছি।'

'বাহ। কি বুঝলি, চাকরিটা হবে? দিনকাল খুব খারাপ রে। এখন অফিস টিমের রিক্রুটমেন্টের সময় টাকা পয়সা খাওয়াখাওয়ি হয়।

আমাদের সময় এমনটা ছিল না।' শুনে মন খারাপ হয়ে গেল চন্দনের। চট করে রাজর্ষির মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। টাকা পয়সা যদি লেনদেন হয়, তা

হলে চাকরি রাজর্ষির মতো ছেলেদেরই হবে। ওর কোনও চান্স নেই। ওর সেন্টার থেকে আজ রাজর্ষি দুটো গোল করেছে। প্রথম গোলটা করার পর দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। বড়লোক বলে যে ছেলেটা পাত্তাই দিত না, সে আজ ভবানীপুর টেন্ট থেকে ওকে শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে বাইকে করে। এ কথা মা জানতে পারলে অবশ্য অসন্তুষ্ট হবে। মণীন্দ্র কলেজ ভর্তি করার সময় মা ওকে সাবধান করে দিয়েছিল, 'বড়লোকের ছেলেদের সঙ্গে মিশবিনা।' চন্দনের চটক ভাঙল বোম্পেলদার কথায়, 'হ্যারে, কামিং সিজনে তুই কি ঐক্যতে থাকবি। শুনলাম, তোকে নেওয়ার কথা সিনিয়র ডিভিশনের কয়েকটা ক্লাব ভাবছে।' চন্দন উত্তর দেওয়ার আগে কাউন্টার থেকে সত্যনারায়ণের মালিক হাঁক পাড়লেন, 'চমচমের প্যাকেটটা নিয়ে যাও ভাই।' প্রশ্নটা করে বোস্পেলদা ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। কাউন্টারের দিকে পা বাড়ানোর সময় চন্দন বলল, 'এখনও কেউ অ্যাপ্রোচ করেনি স্যার। করলে আপনার অ্যাডভাইস নেবো।' চমচমের প্যাকেটটা নিয়ে দোকান থেকে চন্দন বেরিয়ে এল। রাজাবাগান বস্তির দিকে এগোনোর সময় ও দেখল, রাস্তার ধারে কলতলায় জল তোলা নিয়ে তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। তুচ্ছ কারণে বস্তিতে কখনও কখনও বোমাবাজিও হয়ে যায়। কেন জানে না, চন্দনের মাঝে মাঝে মনে হয়, বস্তিতে থাকলে কোনওদিনই ও টপ ফুটবলার হতে পারবে না। এই নরক থেকে ওকে তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। একমাত্র চাকরি পেলেই সেটা সম্ভব। বস্তিতে ঢোকার মুখে মা কালীর একটা মন্দির আছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবার চন্দন মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মা কালীকে প্রণাম করে। মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে ও মনে মনে বলল, 'মা, দেখো, চাকরিটা যেন আমার হয়। আমি যেন আমার মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি।'

রাজাবাগান বস্তিতে ওদের ঘরটা পিচবোর্ড কারখানার দেওয়াল ঘেঁষে। ঘরের কাছে গিয়ে চন্দন দেখল, মা উঠোনে বসে আছে।

এই সময়টা মায়ের মুখার্জি জেঠুদের বাড়িতে রান্না করার কথা। যায়নি কেন! শরীর খারাপ না কি? কিট ব্যাগটা একধারে রেখে ও জিজ্ঞেস করল, 'আজ জেঠুদের বাড়িতে যাওনি।'

ওর উদ্বিগ্ন মুখটা দেখে মা হেসে বলল, 'দরকার হয়নি রে। ও বাড়িতে বাচ্চাটার আজ জন্মদিন। কেটারার ডেকে লোক খাওয়াচ্ছে। তাই আমার ছুটি।' কিট ব্যাগ খুলে চন্দন ওর ফুটবলের সরঞ্জাম বের করতে লাগল। বুট, জার্সি, শর্টস, শিনগার্ড, হোর্স। চমচমের প্যাকেটটা বের করে মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'এই নাও। তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি।'

'হঠাৎ? চাকরিটা তোর হয়ে গেছে না কি?'

'না মা। এখনও দুটো ট্রায়াল ম্যাচ বাকি আছে।' 'জামাটা ঘামে ভিজে গেছে। যা শুকিয়ে চান করে নে খোকা। তোর জন্য জল তুলে রেখেছি। আর হ্যাঁ, বিকেলে মিলি এসে তোর খোঁজ করে গেছে। ফোন করে তুই ওকে বলে দে, ট্রায়ালে কী হল?' মিলি থাকে পেয়ারাবাগানে। মাধ্যমিকের সময় ওর সঙ্গে মিলি পিন্টুদার কোচিং ক্লাসে পড়ত। খুব ভাল মেয়ে। ওর বাবার রেডিমেড পোশাকের দোকান আছে। স্টেশনের কাছে হকার্স মার্কেটে। মিলি এখন মতিঝিল কলেজ পড়ে। প্রায়ই ফেরার পথে এ বাড়িতে এসে ও মায়ের খবর নিয়ে যায়। ও ফুটবল খুব ভালবাসে। নিজে খেলতে চেয়েছিল। কিন্তু কাকিমা... মানে ওর মা খেলতে দেয়নি। তাই দুধের স্বাদ ও ঘোলে মেটায়। টিভিতে ইএসপিএন আর স্টার স্পোর্টসে ও নিয়মিত বিদেশি টিমের খেলা দেখে রাত জেগে। মেসি-রোনাল্ডো নয়, ওর সবথেকে ফেভারিট প্লেয়ার সুয়ারেজ। মিনিট কুড়ির মধ্যে চান সেরে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চন্দন দেখল, রাত সোয়া আটটা বাজে। নটার মধ্যে ওকে শুয়ে পড়তে হবে। গাড়িভাড়াটা হাতে তুলে দেওয়ার সময় ভাস্করদা বলেছিলেন, 'কাল জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে ম্যাচ কিন্তু বেলা ন'টার সময়। তুই আটটার মধ্যে আমাদের টেন্টে চলে আসবি।' ঠিক টাইমের মধ্যে ময়দানে পৌঁছাতে গেলে, ওকে মাদার ডেয়ারির ডিপো খোলার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। মাকে সেকথা বলা হয়নি। বলার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে চন্দন দেখল, মা কথা বলছে শান্তা কাকির সঙ্গে। উঠোনের উল্টো দিকের ঘরটাই কাকিদের।

বোধহয় সাংসারিক কথাবাতাই হচ্ছিল। কাকিকে ও বলতে শুনল, 'তোমার আর চিন্তা কি দিদি, ছেলে জোয়ান হয়ে গেছে। আজ বাদে কাল কোথাও চাকরি পেয়ে যাবে। আমারই মরণ। দু'দুটো মেয়ে। আজ বাদে কাল বে দিতে হবে। কোথেকে কী হবে, ভেবে আমার ঘুম হয় না কো।'

বস্তির রোজকার চলচ্চিত্র। ঘরে ঘরে দুঃখ দুর্দশার কাহিনি। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ। শান্তাকাকির বর যাদবদা রঙের মিস্ত্রির। ওদের দুই মেয়ে মিনু আর বিনু। ছোটবেলা থেকে চন্দন ওদের দেখছে। এই কিছুদিন আগেও, সকালে প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় ওদের দু'জনকে স্কুলে যেতে দেখত।

এখন বোধহয় শান্তাকাকি ওদের কোনও বাড়িতে কাজ লাগিয়ে দিয়েছে। শান্তাকাকির আক্ষেপ শুনে মা বলল, 'ওপারওয়ালার উপর ভরসা রাখো শান্তা। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।'

কথাটা শেষ করার পর মায়ের চোখ পড়ল ওর দিকে। বলল, 'কিরে খোকা, তুই এখনই রাতের খাওয়া সেরে নিবি নাকি? চন্দন বলল, 'ন'টার মধ্যে হলে ভাল হয় মা। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, সেকেন্ড ম্যাচটা কাল সকালে। আমাকে ভোর সাড়ে ছ'টার বেরিয়ে যেতে হবে।

'এ মা, তোকে কী খেতে দিই বল তো? মুখার্জিদের বাড়ি থেকে তোর জন্য চিকেন বিরিয়ানি দিয়েছে। কিন্তু রাতে তোকে ঝাল-মশলার খাবার দিয়েছি শুনলে মিলি রেগে যাবে। আলুসেদ্ধ ভাত খাবি?

শুনে শান্তাকাকি বলল, 'তোমার কি আক্কেল গো সুধাদিদি। জোয়ান ছেলেটাকে তুমি সেদ্ধভাত খাওয়াবে? আমার ঘরে পোনা মাছের ঝোল করেছে মিনু। ওকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি না কোরো নাকো।'

বস্তিতে এমন ধারা বাটি চলাচলি হয়। মা না করার সুযোগই পেল না। ডিনার করার পর চন্দন শুতে যাবে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। এই স্মার্ট ফোনটা ও প্রাইজ হিসাবে পেয়েছিল, মাস কয়েক আগে কাঁকুড়গাছিতে একটা টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে ওখানে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার জন্য বেস্ট প্লেয়ার হয়েছিল। মিলি পরদিন এয়ারটেল কানেকশনটা করে দিয়েছে। চন্দনের খুব ইচ্ছে, চাকরি পেলে প্রথম মাসের মাইনে থেকে মায়ের জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনবে। এমনিতে এদের ঘরে টিভি, মাইক্রোওভেন, টোস্টার, মিক্সচার... সব আছে। একটাও ওকে কিনতে হয়নি। দেবুদার টিমের হয়ে পাড়ায় পাড়ায় খেলতে গিয়ে ওইসব প্রাইজ হিসেবে পেয়েছে। শুধু একটা ফ্রিজ পাওয়া বাকি।

বারকয়েক রিং হয়ে গেছে। অচেনা নাম্বার। ফোনের সুইচ অন করে চন্দন বলল, 'হ্যালো, কে বলছেন? উত্তর এল, 'এখনও ঘুমোতে যাওনি? মেসির কাছে প্রেয়ারটা বোধহয় এখনও করোনি, তাই না?' চন্দন এইবার বুঝতে পারল, ফোন করেছেন পিকে স্যার। মেসির নাম শুনে ও চমকে উঠল। রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মেসির ছবির সামনে বসে ও প্রেয়ার করে, যেন প্রতি ম্যাচে গোল পায়। ও আর মিলি ছাড়া কেউ এ কথা জানে না। পিকে স্যার জানলেন কি করে? নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই চন্দন শুনতে পেল, পিকে স্যার বলছেন, 'চমকে উঠো না খোকা। আমি জানি, তোমার ঘরে দু'জন ফুটবলারের ছবি আছে। তোমার পায়ের দিকের দেওয়ালে মেসির ছবি। ঘুম থেকে উঠেই যাতে তাকে দেখতে পাও। আর তোমার মাথায় দিকে আছে সুয়ারেজের ছবি। তোমার গার্লফ্রেন্ড মিলির খুব পছন্দ তাকে। ঠিক বলছি?' চন্দন জিজ্ঞেস করল, 'স্যার, আপনি কে?

আমার সম্পর্কে এত কথা আপনি জানলেন কি করে।' ধরে নাও না, আমি তোমার একজন ওয়েলউইশার। এত রাতে তোমাকে যে কারণে ফোন করলাম, আগে সেটা বলে নিই।

জর্জের এগেনস্টে কাল সকালে তোমাকে কিন্তু খেলতে হবে মিডফিল্ডে। মাইন্ড ইট, মিডফিল্ড। ভাস্কর দেখে নিতে চায়, তোমার পাসিং ক্যাপাবিলিটি কতটা। মানে মিডল থার্ড থেকে গোল ওপেন করার মতো ক'টা পাস তুমি বাড়াতে পারো, সেটা ও দেখবে। কাজটা তোমার পক্ষে একদম কঠিন না। বিশেষ করে, তুমি মেসিভক্ত বলেই কথাটা বলছি। তোমার পেরিফেরিয়াল ভিশন অনেক বেটার। চন্দন বলল, 'স্যার। জর্জ টিমটার সম্পর্কে তো আমার কোনও আইডিয়াই নেই।' 'বেশ ভাল টিম। ওদের কোচ রঘু নন্দী আজ লুকিয়ে তোমার খেলা দেখে গেছে। কাল তোমাদের এগেনস্টে ও একজন নাইজিরিয়ানকে খেলাবে। ছেলেটার নাম চুকুচুকু। কেউ জানে না, ছেলেটা নাইজিরিয়ার জুনিয়র টিমে খেলছে। চুকুচুকু ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। ওর গায়ে লেগে থাকলে, নর্মাল খেলাটা ও খেলতে পারে না। তোমাকে বলে দিচ্ছি, বল যখন তোমার পজেশনে থাকবে, তখন স্রেফ রাজর্ষির দিকে তাক করে সামনের দিকে বল বাড়িয়ে দেবে। আর বল যখন তোমার পজেশনে থাকবে না, তখন তুমি চুকুচুকুর গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকবে। দরকার হলে ওর হাঁটুর উপর বসে পড়ার চেষ্টা করবে। ওর হাঁটুতে একবার চোট লেগেছিল। তার পর থেকে চুকুচুকু হাঁটু বাঁচানোর চেষ্টায় একটু ফাঁকায় খেলে। এটাই এর একমাত্র উইকনেস কি বললাম, বুঝলে?' 'হ্যাঁ স্যার আজ কিন্তু আপনার টিপস খুব কাজে লেগেছিল। 'আমার কথা আর কাউকে বলেছে না কি?'

'না স্যার। কাউকে বলিনি।'

'ভেরি গুড। আর একটা কথা, একদিনে দুটো ফুল টাইম ম্যাচ খেলার স্ট্যামিনা কি তোমার আছে?' 'আছে স্যার। আমি প্রচুর ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট খেলি। আমার কোনও অসুবিধা হয় না। কেন স্যার?

'কাল হয়তো তোমাকে বিকেলেও একটি ম্যাচ খেলতে হতে পারে। রেডি থেকো। যাক, আর তোমাকে বিরক্ত করব না। হ্যাভ আ নাইস স্লিপ। গুডনাইট খোকা। কাল দুপুরে তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে।'

 

।। তিন।।

 

জর্জ ম্যাচে সেকেন্ড হাফের মাঝামাঝি চন্দন লক্ষ্য করল, সাইড লাইন থেকে ভাস্করদা হাত তুলে ওকে ডাকছেন। মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন সাইড লাইনে রাজেন মিতে বলে একটা ছেলে ওয়ার্ম আপ করছে। ছেলেটাকে দেখে চন্দন বুঝতে পারল, ভাস্করদা ওকে নামাতে চান। মণিপুরের ছেলে আজই সেন্ট্রাল এক্সাইজ ক্লাবে ড্রেস করে মহমেডান স্পোর্টিং মাঠে যাওয়ার সময় রাজেন যেচে ওর সঙ্গে আলাপ করেছিল। মিডফিল্ডে খেলে। গতবছর রেনেডি সিংহের কথায়, মুম্বই এফ সি-তে সই করেছিল। আইএসএল মানে ইন্ডিয়ার সুপার লিগের টিম। একটা ম্যাচেও খেলার সুযোগ পায়নি। রাজেন এ বার কলকাতায় ফিরে এসেছে,

যদি কোনও ক্লাব টিম পায়, সেজন্য। চন্দন বুঝতে পারল না, ভাস্করদা কেন ওকে তুলে নিতে চাইছেন? ও তো খারাপ খেলছিল না। ফার্স্ট হাফে ওর পাস থেকে রাজর্ষি একটা গোল করেছে। এই সময়ের মধ্যে গোটা ছয়েক এমন ডিফেন্স চেরা পাস পাঠিয়েছে, যা থেকে আরও গোল হতে পারত। খেলার মাঝেই জর্জের স্টপার জিজ্ঞেস করেছিল, 'এই, তোর নাম কি রে?' হাফ টাইমে ওর বাড়ির ঠিকানাও জানতে চায়। ম্যাচ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় এক ঘণ্টা চন্দন তেমনভাবে খেলে গেছে, পিকে স্যার যেমনটি ওকে খেলতে বলেছিলেন। জর্জের নাইজিরিয়ান ছেলেটাকে ও এক মুহূর্ত স্বস্তি দেয়নি।

ছেলেটা ইংরেজিতে ঘরঘরে গলায় একে কী বলছিল, চন্দনের মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু এটা ও বুঝতে পারছিল, চুকুচুকু ওকে নিজের খেলাটা খেলতে বলছে।

হাফ টাইম পর্যন্ত ওদের সেন্ট্রাল এক্সাইজ টিম এক গোলে এগিয়ে ছিল। কিন্তু সেকেন্ড হাফে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জর্জ দুটো গোল করে ফেলায় পুরো খেলাটা ঘুরে গেল। তার পরই ভাস্করদার ডাক। দেখে রাজর্ষি দৌড়ে এল ওর কাছে। বলল, 'ভাস্করদার মাথা খারাপ হল না কি রে? তোকে তুলে নিচ্ছে! আমাকে বলটা বাড়াবে কে? তুই মাঠ থেকে বেরোবি না চন্দন। আমি গিয়ে কথা বলছি কোচের সঙ্গে।'

চন্দন বলল, 'প্লিজ, তুমি কোনও ঝামেলা কোরো না। কোচের কথা আমার শোনা উচিৎ। রাজর্ষি রেগে বলল, 'এই সব গাণ্ড কোচদের জন্যই বাংলার ফুটবলের আজ এই অবস্থা।'

ধীর পায়ে হেঁটে চন্দন মাঠের বাইরে বেরিয়ে এল। বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। ঘামে ওর জামাটা শরীরের সঙ্গে এঁটে রয়েছে। গলা তেষ্ঠায় শুকিয়ে গেছে। সেন্ট্রাল এক্সাইজ টিমের রিজার্ভ প্লেয়াররা যেখানে বসেছে, সেখানে গিয়ে চন্দন ক্রেট থেকে একটা জলের বোতল তুলে নিল।

খানিকটা মুখের ভিতর দিয়ে, বাকি জলটা ও মাথায় ঢেলে দিল। ফাঁকা একটা চেয়ারে বসতেই পাশ থেকে একজন বললেন, 'ওয়েল প্লে চন্দন। তোমাকে দেখে আজ আমার কৃশানু দের কথা মনে পড়ছিল। রাজর্ষি যে বলটা থেকে প্রথম গোল পেল, সেটা জেম অফ আ পাস।' চন্দন পাশ ফিরে দেখল, একজন বয়স্ক মানুষ। ও বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।'

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, 'আমি পিকে সেনগুপ্ত। সেন্ট্রাল এক্সাইজ ক্লাবের সেক্রেটারি। শুনলাম তুমি ঐক্য সম্মিলনীতে খেলো। তুমি কি ওই অঞ্চলে মানে... দমদমে থাকো 'হ্যাঁ স্যার, সাউথ সিঁথিতে। রাজাবাগানের ঝোড়ো বস্তিতে। দমদম স্টেশনের কাছে।

'কদ্দুর লেখাপড়া করেছ?'

'বি কম সেকেন্ড ইয়ার। শ্যামবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে পড়ি।'

'আই সি। তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? তোমাদের ফ্যামিলিতে কি কেউ ফুটবল খেলতেন?' 'জানি না স্যার। আমার যখন দু'বছর বয়েস, তখন বাবা মারা যান। মা ছাড়া আর কেউ নেই।' 'ধরো, আমরা তোমাকে চাকরিটা দিলাম। তার পর তুমি ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান থেকে ডাক পেলে। তখন তুমি কি করবে?

চাকরি ছেড়ে দেবে।'

'জানিনা স্যার। এতদূর ভাবিনি। আমার মা যা বলবে, আমি তাই করব।'

কথাটা বলে চট করে চন্দনের পিকে স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। মা এতসব বোঝে না। সত্যি কথা বলতে কি, এই সমস্যার যদি কোনওদিন ও পড়ে, তা হলে পিকে স্যার যা বলবেন, সেটাই ও করবে। মানুষটার উপর ওর এমন বিশ্বাস জন্মে গেছে। তেমন হলে মিলির সঙ্গেও একবার পরামর্শ করতে পারে। মিলি অবশ্য মনে করে, চাকরি করে বড় ফুটবলার হওয়া যায় না। ফুটবলটাকেই পেশা হিসেবে নেওয়া দরকার। তুমি আইএসএলে খেলার কথা চিন্তা করো চন্দনদা। ওটাই তোমার মোক্ষ হওয়া উচিত।

পিকে সেনগুপ