পরিতোষ চক্রবর্তী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক অবয়ব ব্যাতীত ক্রীড়ামোদী সত্তার সাথে পরিচিত এমন বাঙালির সংখ্যা খুবই নগণ্য। যদিও দু-একটি ক্রীড়া ক্ষেত্রের সাথে রাবীন্দ্রিক যোগসূত্রের বিষয়টি কিছু মানুষের অজানা নয়। কিন্তু কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন লাল-হলুদ তাঁবুর সাথে একেবারে কবিগুরুর আত্মিক টানের ঘটনাটি তাঁর বর্ণময় জীবনের অনালোচিত একটি পর্ব। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে লেসলি ক্লডিয়াস সরণিতে খেলে যাওয়া কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সূর্য চক্রবর্তী। সালটা ১৯২৭, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অধিনায়কত্ব সামলাবার মতো গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছিল তাঁরই কাঁধে। ধারাবাহিকভাবে দশটি বছর লাল-হলুদ জার্সি গায়ে কলকাতা ময়দান কাঁপিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের অনবদ্য এই রাইট-ইন ফুটবলার। ১৯২৯ সালে তাঁর মাতৃসম ক্লাব যখন কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশন থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে যায়, সেই সময় প্রায় একার বাহুবলে ক্লাব ফুটবলের হৃত গৌরবকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনেন সূর্য চক্রবর্তী।
অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার বিক্রমপুরের কাইচল গ্রাম সাক্ষী ছিল তাঁর বাল্য ও কৈশোর জীবনের। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, তাঁর পিতা কুমিল্লার স্বনামধন্য আইনজীবি ললিতমোহন চক্রবর্তীর সাথে সাক্ষাৎ হয় ত্রিপুরা পথগামী রবি ঠাকুরের। আলাপচারিতার মাঝে, উকিল মহাশয়ের পুত্র সূর্য চক্রবর্তীর ফুটবল খেলার প্রতি উদগ্র বাসনার কথা জেনে বিশ্বকবি চক্রবর্তী মহাশয়কে আদেশ দেন পুত্রকে শান্তিনিকেতনে পাঠানোর। সেই সময়ে ঢাকার ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ফুটবলার সূর্য চক্রবর্তী এতটুকুও কালবিলম্ব না করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশমতো শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই সময়ে ঢাকার খ্যাতনামা দুটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ওয়ান্ডার্স ও উয়ারী ক্লাব দুটি থেকে কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবলারদের খেলতে আসা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক একটি বিষয়। শান্তিনিকেতনে এসে সূর্য চক্রবর্তীর খেলোয়াড় জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি কবিগুরুর 'বিশ্বভারতী একাদশ' নামের ফুটবল দলটিতে নিয়মিত ফুটবল খেলা শুরু করেন তিনি। সামান্য কয়েকদিনেই তাঁর পায়ের জাদুকাঠিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রীষ্মকালীন অবকাশের দিন গুলিতে সূর্য চক্রবর্তীকে কবিগুরু পাঠিয়ে দিতেন কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে। সেখানে তাঁর পাকাপাকিভাবে থাকারও একটি বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর উপস্থিতিতে নানান সময়ে ফুটবলীয় প্রীতিম্যাচের আয়োজন বসতো শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী একাদশের সাথে সেই ম্যাচ খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন কলকাতার বিভিন্ন প্রথিতযশা ক্লাব বা কলেজের দলগুলিকে। সূর্য চক্রবর্তীর ফুটবল নিপুনতা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রবি ঠাকুরকে বাধ্য করে তাঁকে কলকাতার বড় দলে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিতে। কথিত আছে, ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে টানা দশ বছর খেলে যাওয়া এই দলনায়কের দুখিরাম মজুমদারের ফুটবল অনুশীলন কেন্দ্রে যোগ দেওয়ার পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নির্দেশমতো মজুমদার বাবুর অধীনে এরিয়ান্স ক্লাবেই অনুশীলন শুরু করেছিলেন সূর্য চক্রবর্তী। সালটা ১৯২৫, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশকে পাথেয় করেই তিনি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জার্সিকে নিজের করে নেন। লাল-হলুদ ব্রিগেডের প্রাক্তন এই কিংবদন্তী তাঁর ফুটবল জীবনের কথা বলতে গিয়ে তাঁর কর্মগুরু বিশ্বকবি কে গুরুদক্ষিণা দিতে ভোলেননি। তিনি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যই আজ তিনি খেলোয়াড় সূর্য চক্রবর্তী।
এরকমই আরেকটি রোমাঞ্চকর ঘটনা শোনা যায় চল্লিশের দশকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এক সময়ের অধিনায়ক পরিতোষ চক্রবর্তীর লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপানোর নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপ্ত ভূমিকা। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৯, টানা সাত বছর লাল-হলুদ বাহিনীর হয়ে দাপটের সাথে ফুটবল খেলেছিলেন পরিতোষ চক্রবর্তী। ক্লাবের প্রথম শিল্ড জয় এবং একই মরশুমে আই.এফ.এ শিল্ড ও লিগ জয়ের রেকর্ড তাঁরই ঝুলিতে। ৬ ফুট তিন উচ্চতার অধিকারী লাল-হলুদের রক্ষণভাগের এই খেলোয়াড়টি বিংশ শতকের তিরিশের দশকে কলকাতার বঙ্গবাসি কলেজে পাঠরত ছিলেন। কলেজের ফুটবল দলের তালিকায় নিয়মিত তাঁর নাম থাকতো। ১৯৩৫ সালের কোনও এক সময়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলেজের অধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লেখেন তিনি। যার বিষয়বস্তু ছিল শান্তিনিকেতনের 'বিশ্বভারতী একাদশের' সাথে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ। সেই চিঠিতে এটাও উল্লেখিত ছিল বঙ্গবাসি কলেজের খেলোয়াড়দের সুনামের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচিত হওয়ার দিকটি। প্রীতি-ম্যাচটিতে ১-০ গোলের ব্যাবধানে জয় হাসিল করে বঙ্গবাসি কলেজ। বিশ্বকবির আশীর্বাদধন্য হয়েই খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলেন। এবং ম্যাচ শেষে বিজয়ী বঙ্গবাসি কলেজের ফুটবলারদের সিল্কের কাপড়ে মোড়া শক্ত কভার আচ্ছাদিত গীতাঞ্জলি উপহার হিসেবে স্বহস্তে তুলে দিয়েছিলেন। বঙ্গবাসি কলেজের সেই দলের সদস্য পরিতোষ চক্রবর্তীর খেলায় বিস্মিত হয়ে তাঁকে আশীর্বাদও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শুধুমাত্র গদ্য-কবিতা-নাটকের গন্ডিতে নিজেকে আটকে না রেখে ক্রীড়াক্ষেত্রেও নিজেকে স্বমহিমায় মেলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জহুরীর চোখ অনায়াসেই খুঁজে নিতে পারতো সমসাময়িক প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের।
Powered by Froala Editor