Search

Suggested keywords:

Dui Footballer er Lorai | দুই ফুটবলারের লড়াই

Dui Footballer er Lorai | দুই ফুটবলারের লড়াই

দুই ফুটবলারের লড়াই

রাজর্ষি গাঙ্গুলি


‘ফোনটা বাজছে তো কখন থেকে৷ ধরতে পারছিস না? সারাদিন কোন কাজ নেই৷ শুধু খেলে বেড়াবে৷ আর বেলা অবধি ঘুমাবে৷ ফোনটা ধরতে পারছিস না?

ফোনটা বাজতে বাজতে থেমে যাওয়ার আগেই হঠাৎ একচিলতে ঘরটায় অন্য শব্দ শুরু হয়েছে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দটার তীব্রতা বাড়ছে৷ ঘরের মাথার উপর টালিগুলোতে কাঁপুনি ধরেছে৷ যত সময় যাচ্ছে, গোটা ঘর জুড়ে কাঁপুনিটা শুরু হলো৷ সঙ্গে তীব্র হচ্ছে ট্রেনের শব্দ৷

‘৮.৩২ এর ট্রেনটা এসে গেলো৷ আমি এখনও কাজে বেরোতে পারলাম না৷ সব কাজ যদি আমাকেই করতে হবে তাহলে তো দেরি হবেই৷ কাজের বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে দিক আমাকে৷ কারোর আর খাওয়া জুটবে না৷ সুমিত্রার কথাগুলো হারিয়ে গেলো ট্রেনের প্রচণ্ড শব্দে৷ ট্রেনটা চলে যাওয়ার আগেই সুমিত্রা বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে৷ আবার ফোনটা বাজছে৷ এবার সুখেন ঘুম জড়ানো চোখে কোনরকমে ফোনটা ধরলো৷

‘হ্যালো৷’

‘সুখেন মণ্ডল বলছো?’

‘হ্যাঁ৷ কে আপনি?’ ‘তুমি আমাকে চিনবে না৷ শোন তোমার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে৷ তোমার তো বাবার শরীর খারাপ?’

‘হ্যাঁ৷ আপনি কি করে জানলেন?’

‘দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস৷ ওষুধের দোকানে তোমার ধার প্রায় চার হাজার টাকা৷ ওরা আর ওষুধ দেবে না বলেছে৷ এটা ছাড়া তোমার বাবার চিকিৎসার জন্য এখন আর হাজার আটেক টাকা দরকার৷ আমি চাইনা তোমার বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যান৷ তাই তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই৷ তোমাকে আমরা কুড়ি হাজার টাকা দেবো৷ তার জন্য তোমাকে একটা ছোট্ট কাজ করতে হবে৷’ আপনারা হঠাৎ আমাকে এতো টাকা কেন দেবেন? আর কি কাজ করতে হবে আমাকে?

‘সব কথা কি ফোনে হয় ভাই? আজ রাত দশটা নাগাদ বীরপাড়ার মাঠে আসো৷ মাঠের পিছনে যে ভাঙা গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে থাকবো আমি৷ কথা হবে৷ অপেক্ষা করবো তোমার জন্য৷’ সুখেন আর কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেলো৷ ঘরটায় আর কোন শব্দ নেই৷ অনেকটা দূর থেকে অনেকগুলো গলার শব্দ৷ রেলবস্তির কলের লাইনে রোজকার ঝগড়াটা শুরু হয়ে গেছে৷ বিছানায় শুয়েই ছাদের দিকে তাকালো সুখেন৷ টালির ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে ঘরটায়৷ না৷ তাতে ঘরের অন্ধকারটা কাটেনি৷ আধো অন্ধকারে নোনা ইঁটের দেওয়ালটায় মেসির পোস্টারটা প্রায় দেখা যাচ্ছে না৷ তবু সুখেনের মনে হলো মেসির চোখগুলো যেন ভীষণ উজ্জ্বল লাগছে৷ মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে৷ ফ্যানের হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের কোণাটা বারবার ধাক্কা খাচ্ছে ইটের দেওয়ালে৷ ঘরের একপাশে ডাঁই করে রাখা কটা জার্সি, প্যান্ট৷ তার পাশে একটা ভাঙা কাঠের টেবিলের উপর বেশ কয়েকটা ধুলোমাখা ট্রফি৷ অনেকগুলো মেডেল৷

হঠাৎ কাশির শব্দ৷ কাশিটা হয়েই যাচ্ছে৷ সুখেন বিছানা থেকে উঠে ঘরের বাইরে বেরোলো৷ মা কাজে বেরোনোর আগে বাবাকে ঘরের বাইরে চেয়ারে বসিয়ে রেখে গেছে৷ বাবার কাশিটা আবার বেড়েছে৷ সুখেনের আর কিছু ভালো লাগছে না৷ বাবা কারখানা থেকে ছাঁটাই হয়েছে প্রায় বছর ঘুরতে চললো৷ কলেজে ঢুকে পড়াটা ছেড়ে দিতে হয়েছে সুখেনকে৷ ওর মা চার বাড়িতে কাজ করে৷ সেটাতেই আপাতত সংসার চলে৷ এর মধ্যে সুখেন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা ছাড়েনি৷ গোটা জেলার সব স্ট্রাইকাররাই ভয় পায় সুখেনকে৷ স্টপার হিসাবে ওর টাফ ফুটবলের জন্য কোচেদের ফার্স্ট চয়েসে সবসময় থাকে সুখেন৷ খেপের মাঠে বেশ নামডাক আছে৷ নাইজেরিয়ান বিদেশিগুলোর বিরুদ্ধে ছেলেটা একফোঁটা কাঁপে না৷ কিন্তু প্রগতি সংঘের কোচ দীপু স্যার কিছুতেই সুখেনকে খেপ খেলতে দেন না৷ যদি জানতে পারেন সুখেন যে খেলেছে পরের দিন প্রগতি সংঘের মাঠে দশ পাক দৌড়াতে হয় সুখেনকে৷ তারপর প্র্যাকটিসের শেষে সুখেনকে আলাদা করে ডেকে কখন ২০০, কখন ৩০০ টাকা দিয়ে বলেন, ‘সুখেন প্লিজ খেপ খেলে ভবিষ্যৎটা নষ্ট করিস না৷ আমি তোর অবস্থাটা জানি৷ একটু ধৈর্য্য ধর৷ আমি চেষ্টা করছি যাতে প্রিমিয়ারের কোন ক্লাবে তোর হয়ে যায়৷ একটু ধৈর্য্য ধর সুখেন৷ মাঠের লড়াইটার সঙ্গে বেঁচে থাকতে গেলে যে মাঠের বাইরের লড়াইটা রোজ জিততে হয় রে৷

কি মনে হচ্ছে ফাইনালটা জিততে পারবি? বাবার প্রশ্নটা শুনে হকচকিয়ে গেলো সুখেন৷ সুখেনের বাবা বরাবর চেয়ে এসেছেন ছেলে ফুটবলার হোক৷ সুখেন একটা গ্রিল কোম্পানিতে কাজ পেয়েছিলো৷ ওর বাবা রাজি হননি৷ বলেছিলেন, ‘শোন একটু কষ্ট কর সুখেন৷ গ্রিল কোম্পানির কাজে ঢুকলে তোর আর ফুটবল খেলাটা হবে না রে৷ যে স্বপ্নটা দেখিস৷ সেটাকে সত্যি করার জন্য একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে৷’ ‘বাবা তোমার শরীর কেমন আছে?’

ভালো৷

আমি ঠিক আছি৷ শোন কাল বিকাল অবধি আমার কথা ভাবিস না৷ একটাই কথা ভাব৷ কাল জিততে হবে৷ ইয়ং স্টার কলকাতায় প্রিমিয়ার খেলা পাঁচটা ছেলে আনছে৷ তার মধ্যে শেরপা বলে ফরোয়ার্ডটা বেশ৷ ‘তুমি এতোসব জানলে কি করে?’ না হয় এখন শরীরটা খারাপ৷ তাই আর বেরোতে পারি না৷ চেনা লোক তো আছে রে কিছু৷ আর একটা কথা শোন৷ শুনলাম প্রিমিয়ারের দুটো ক্লাবের স্পটার কাল থাকবে৷ দীপু বলবে তোকে কথাটা৷ জান দিয়ে খেলিস৷ তোকে তো আমি কিছুই দিতে পারি না৷ উলটে আমার চিকিৎসার জন্য তোকে খেপ খেলতে হয়৷ কাল জিতলে যে টাকাটা পাবি আমার জন্য ওষুধ নয়৷ ময়দান মার্কেটে গিয়ে নিজের জন্য একটা ভালো বুট কিনিস৷’

চোখটা ছলছল করে উঠলো সুখেনের৷ বাবা আর পালটালো না৷ ছোট থেকে ফুটবল নিয়ে মাতামাতিটা একইরকম রয়ে গেলো৷ বিশ্বকাপের সময় রোজ রাতে ক্লাবে নিয়ে যেত সুখেনকে৷ প্রতিটা খেলা দেখিয়ে শিখিয়ে দিতো একটা স্টপারের কি করা উচিত৷ রোজ সকালে স্কুলের আগে মাঠে নিয়ে যেত৷ বডদের প্র্যাকটিসের মধ্যেই ছেড়ে দিতো ছেলেকে৷ ছেলে চোট পেলে ঘরে নিয়ে এসে নিজে ওষুধ লাগিয়ে দিতো৷ আবার পরেরদিন নিয়ে যেতো মাঠে৷ সুখেনের বাবা নিজে ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন৷ অসম্পূর্ণ স্বপ্নটা ছেলেকে দিয়ে পূরণ করতে চান তিনি৷

জলের বালতিটা নিয়ে কলের লাইনে এলো সুখেন৷ বিশাল লাইন৷ লাইনে বালতিটা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই  দেখতে পেলো বিকাশকে৷ সাইকেল নিয়ে যাচ্ছে৷ বিকাশ প্রগতি সংঘের গোলরক্ষক৷ বস্তিতেই থাকে৷

‘এই বিকাশ৷ কোথায় যাচ্ছিস?’

‘তুই?’

‘কেন ভূত দেখলি নাকি রে৷’

‘না না৷ একটু তাড়ায় আছি রে৷ দুপুরে প্র্যাকটিসে দেখা হবে৷’

 সুখেন আর কিছু বলার আগেই বিকাশ উধাও৷ আবার ওর ফোনটা বাজছে৷ চেনা নাম্বার৷ প্রিয়াঙ্কা৷

‘তুই কোথায় রে?’

‘আমার তো আর দোতলা বাড়ি নেই তোর মতো৷ বস্তিতে থাকি৷ তাই বস্তির কলে সকালবেলা বালতি নিয়ে দাঁড়াতে হয়৷’

‘সব সময় তুই কেন এভাবে কথা বলিস আমার সঙ্গে?’ ভালোবাসি বলে তোকে? আমি কবে বড়লোকি দেখালাম তোকে?

‘তা তো দেখাস না৷ ওই যে আহা উঔ করিস৷’ ‘তোর যত রাগ তো আমার উপর৷ কই বাবাকে তো কিছু কোনদিন বলতে দেখলাম না?’ ‘দীপু স্যার কে আমি কিছু বলতে পারি না৷’

‘তা পারবি কেন? সব কিছু তো আমার উপর তোর৷’ ‘কাজের কথা আছে তোর কোনও?’

‘টিউশনির টাকাটা পেলাম আজ৷ তোকে দেবো৷ ওষুধের দোকানে অন্তত কিছুটা টাকা মেটা৷’

দয়া করছিস? লাগবে না৷ আমি আজ ২০০০০ টাকা পাবো একজনের থেকে৷ সব মিটিয়ে দেবো৷’ ‘কি সব বলছিস তুই? কে দেবে তোকে এতো টাকা?’ ‘আজ রাতে দেখা করতে বলেছে একজন৷ শোন আমার আর কিছু করার নেই৷ বাবার কি হলো সততা করতে গিয়ে? কি হলো বলতো নীতি ধরে থাকতে গিয়ে? ইউনিয়ন৷ মিছিল৷ মালিকের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? লাভ হলো ছাঁটাই৷ বাবার পাশে তখন যাঁরা ছিলো তারা কিন্তু রঙ পালটে ফেলেছে৷ কারখানায় আবার কাজ করছে, অন্য ইউনিয়ন করছে৷ বাবা পারলো না৷ বললো মরে যাবো, তবু পালটাবো না৷ লাভ কি হলো? এমনিতেই কয়েকদিন পর বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে৷ তাও এখন পার্টির মিছিলে যায়৷ আশ্চর্য লাগে লোকটাকে দেখে৷ তাই আমি ঠিক করেছি লোকটা খুন, ডাকাতি যাই করতে বলুক করবো৷ আমার কথা শোন, মাথাটা ঠান্ডা কর৷ কাল একটা ইম্পর্টেন্ট ম্যাচ৷ বাবা পাগলের মতো করছে টেনসনে৷ তোর উপর বাবার অনেকটা ভরসা৷ তুই একটু ভালো করে খেল কাল৷ স্পটার আসবে৷ তোর দেখবি ঠিক ভালো দলে চান্স হয়ে যাবে৷ আমি পুজো দিয়েছি আজ সকালে মন্দিরে৷’

ফোনটা কেটে জলটা নিয়ে ঘরে গেলো সুখেন৷ বাবার খাবারটা দিয়ে স্নান করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো৷ বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো৷ কে হতে পারে লোকটা৷ কিই বা চায়? তারপর কিটসব্যাগ গুছিয়ে মাঠে এসে  দেখলো বিকাশ ওর আগে এসেই ড্রেস করে নিয়েছে৷ একটু যেন আনমনা লাগছে আজ ছেলেটাকে৷ প্রথমে জগিং৷ তারপর শুরু হলো ম্যাচ প্র্যাকটিস৷ প্র্যাকটিসে দুটো বাজে গোল খেলো বিকাশ৷ স্যার ছুটে এলেন৷

‘এই বিকাশ কি হয়েছে তোর? কাল ম্যাচ৷ আজ তুই এরকম ছাগলের মতো গোল খাচ্ছিস? আর এতো অন্যমনস্ক লাগছে কেন তোকে?’

‘না স্যার৷ কিছু না৷ গার্ড হয়ে গিয়েছিলো শটটার সময়৷’ ’তাহলে তুই কল করলি না কেন?’

‘সরি স্যার আর হবে না৷’

ঘন্টা দুয়েক প্র্যাকটিস করিয়ে গোটা দলকে ডেকে দীপু স্যার বললেন, ‘ইয়ং স্টারের খেলা নিয়ে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু ছিলো না৷ পাচ্ছি দুটো কারণে৷ এক গত ম্যাচে রাহুল চোট পেয়েছে৷ দলের মেন স্ট্রাইকার নেই আমাদের৷ দুই, ওরা পাঁচজন কলকাতা প্রিমিয়ারের প্লেয়ার নিয়ে আসছে৷ ক্লাবের তরফে আমরা ইতিমধ্যে কমপ্লেন জানিয়েছি৷ তবে তাতে লাভ হবে না৷ ওদের পলিটিক্যাল পাওয়ার মারাত্মক৷ ওরা ট্রফি পাওয়ার জন্য যা খুশি করতে পারে৷ কিন্তু আমি তোদের ভরসা করি৷ জানি তোরা ফাইনালে জান লড়িয়ে দিবি৷ আমরাই জিতবো৷’

মাঠ থেকে বেরোনোর মুখে দীপু স্যার চেঁচিয়ে ডাকলেন৷ সুখেন যাওয়ার আগে শুনে যাস৷

বলুন স্যার৷

‘প্রবীরদা কেমন আছে?’

‘একইরকম৷’

‘কাল ওই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সেরা খেলাটা খেল সুখেন৷’

‘যে দু’জন স্পটার আসছে ইতিমধ্যে ওরা তোর নামটা জানে৷ এই সুযোগ আর পাবি না৷’

‘আমি চেষ্টা করব স্যার৷’

‘বাকিদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গুলতানি করে বাড়ি ফিরল সুখেন৷’

মা চলে এসেছে৷  বাবার সঙ্গে একটু কথা বলে  খেয়ে নিল তিনজনে৷ 

বাবাকে বলল, ‘বাবা৷ আজ রাতে দীপু স্যার কয়েকজনকে ডেকেছেন৷ আমি ঘুরে আসছি৷’

বীরপাড়ার মাঠ রেললাইনের পাশে৷ জঙ্গল হয়ে গেছে মাঠটা এখন৷ ভাঙা গাড়িটার সামনে দাঁডিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো ৯টা ৫৮৷

‘আমি খুব খুশি হয়েছি৷ তুমি এসেছো দেখে৷

চমকে উঠলো সুখেন৷ গলাটা এসেছে ওর পিছন দিক থেকে৷ অন্ধকার ফুঁড়ে একটা লোক বেরিয়ে এলো৷

লোকটা বেশ লম্বা৷ মাথায় একটা টুপি৷ গাঢ় রঙের জামা প্যান্ট পরে৷ এক মুখ দাঁড়ি৷

‘কে আপনি?’

‘সেটা জেনে তুমি কি করবে? ধরো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী৷ এই খামটা ধরো৷’ সুখেনের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলো৷

‘এই খামে পুরো টাকাটাই আছে৷ অবাক হচ্ছো তো? টাকা কেন দিচ্ছি? না, এই পৃথিবীতে অকারণে কেউ কাউকে কিছু দেয় না৷ তোমাকে একটা ছোট কাজ করতে হবে৷’ ‘কি?’

‘কাল ম্যাচে তোমাকে ইয়ং স্টারের হয়ে খেলতে হবে৷’

‘মানে?’

‘মানে তুমি খেলবে প্রগতি সংঘের হয়েই৷ কিন্তু জেতাবে ইয়ং স্টারকে৷ তুমি আমাদের স্ট্রাইকারকে আটকাবে না৷ এমনভাব করবে যেন চেষ্টা করছো৷ কিন্তু পারছো না৷’

‘আমি স্যারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না৷’ ‘হা হা হা স্যার৷ কত দেয় তোমাকে তোমার স্যার৷ কখন ১০০, কখন ২০০৷ টাকাটা নিয়ে বাড়ি চলে যাও৷ তুমি দেখো আগে বাবার প্রাণ, নাকি আগে স্যার৷ আসলাম৷’

লোকটা চলে যাওয়ার পর আলোয় এসে সুখেন দেখলো খামের মধ্যে দশটা কড়কড়ে ২০০০ টাকার নোট৷ সারাটা রাত এপাশ পাশ করে কাটিয়ে দিলো সুখেন৷ একটা অদ্ভুত টানাপোডেন৷ নিজের মধ্যে৷ স্যারের সঙ্গে কি করে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? আবার টাকাটাও যে সত্যি ভীষণ প্রয়োজন৷

খেলা দুপুর তিনটেয়৷ ব্যারিকেডের চারদিকে লোক গিজগিজ করছে৷ চারপাশের দোতলা বাডির ছাদগুলো ভর্তি৷ ম্যাচটা প্রেস্টিজ ফাইট দু’দলের কাছেই৷ দু’ক্লাবের সমর্থকদের চিৎকারে কান পাতা দায়৷ যথারীতি প্রগতি সংঘের কোনও আবেদনেই কাজ হয়নি৷ সেমিফাইনাল অবধি ইয়ংস্টারের যে দলটা খেলছিলো সেখানে পাঁচটা চেঞ্জ৷ কলকাতা থেকে পাঁচটা প্লেয়ার নিয়ে দল নামিয়েছে ইয়ংস্টার৷

খেলার শুরু থেকেই ঝড় তুলেছে ইয়ংস্টার৷ দু’দিক থেকে অ্যাটাক করে ফালাফালা করে দিচ্ছে প্রগতি সংঘকে৷ একটা বিষয় মাঠে নামার আগে খেয়াল করেছে সুখেন৷ ইয়ং স্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচের চেহারা, গলার স্বরও কাল রাতের লোকটার মতো৷ সুখেন তাকাতেই মুখটা ঘুরিয়ে নিলো লোকটা৷ সাইড লাইন থেকে চিৎকার করে যাচ্ছেন দীপু স্যার৷ ‘হোল্ড সুখেন হোল্ড৷ খেলাটা ছড়া। স্লো কর৷ সুখেন লিড কর৷’

সুখেনের কানে যেন কিছুই ঢুকছিলো না৷ শুধুই একটা টানাপোড়েন৷ ফুটবলটা বেছে নেবে নাকি যাঁর জন্য ফুটবলার হয়েছে তাঁকে? ইয়ং স্টারের একটা ফরোয়ার্ড মোহনবাগান, মহমেডানে খেলেছে৷ বয়স হয়েছে, স্পিড কমেছে৷ কিন্তু পায়ে এখন দারুন স্কিল৷ আর একজন মিজো ফুটবলার মারাত্মক দৌড়াচ্ছে৷ সুখেন দেখলো প্রগতির দুই উইং ব্যাক দিব্যেন্দু আর বিনয় দমে পারছে না৷ ম্যাচ প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেছে৷ একতরফা খেলা হচ্ছে৷ সুখেনের পাশে বিষ্ণু দারুন খেলছে৷ সুখেন দু’একটা ছোটখাটো ভুল করলে বিষ্ণু সামলে দিচ্ছে৷ 

হঠাৎই একটা ফলস খেলো বিষ্ণু ওদের ফরোয়ার্ডটার সামনে একা সুখেন৷ পিছনে বিকাশ৷ দীপুদার চিৎকারটা কানে যাচ্ছে না সুখেনের৷ চার্জে যেতে গিয়ে যেন পা-টা আটকে গেলো৷ কাটিয়ে নিয়ে অবলীলায় গোল করে গেল ছেলেটা৷ বিকাশ চেষ্টা করলো না৷ ইয়ং স্টার সমর্থকদের চিৎকারে কান পাতা দায়৷ সুখেন মাটিতে মুখ গুজে শুয়ে আছে৷ এটা কি করলো সুখেন? কি করে করতে পারলো এটা? এতোটা বিশ্বাসঘাতকতা?

প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে আর একটা গোল খেলো প্রগতি৷ সুখেনের মনে হলো কর্নার থেকে ইচ্ছা করে যেন বলটা না গ্রিপ করে ওদের ফরোয়ার্ডের পায়ে দিয়ে দিলো বিকাশ৷ সেই বলটাই গোল৷ 

হাফ টাইমে দীপু স্যার একটা কথা বললেন না৷ খেলোয়াড়ারা যেন ম্যাচটা হেরে গেছে৷ শরীরগুলো পড়ে আছে এখানে সেখানে৷ সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই৷ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে সুখেন৷  দেখলো সবাই মাঠে চলে গেলো৷ বিকাশ বসে আছে৷ ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে৷ সুখেন আস্তে করে ডাকলো ‘বিকাশ?’ 

ভাই আমার বোনের বিয়েতে আমরা পুরো টাকাটা দিতে পারিনি৷ রোজ বোনটার উপর অত্যাচার করে৷ বাড়ি গেলেই এক কথা শুনতে হয় আমাকে৷ ভাই পারলাম না ভাই৷ বিক্রি হয়ে গেলাম মাত্র কুড়ি হাজার টাকার জন্য৷ পারলাম না ভাই৷ আমি স্যারকে বলছি আমাকে তুলে নিতে৷ আমি পারবো না ভাই এভাবে৷ ‘আমাকে ওরা কাল কুড়ি হাজার দিয়েছে৷ বাবার অবস্থা তো জানিসই৷ ওষুধের দোকানে অনেকগুলো টাকা পায়৷’

‘ভাই৷ বাঁচতে ইচ্ছা করছে না আর৷’

হঠাৎ সুখেনের মনে হলো দরজার কাছে কেউ একটা দাঁড়িয়ে৷

‘বাবা তুমি!’

‘মাত্র কুড়ি হাজারে বিক্রি হয়ে গেলি তোরা? মাত্র কুড়ি হাজারে? কারখানার সামনে তখন আমরা পিকেটিং করছি৷ হঠাৎ আমাকে একজন ডেকে নিয়ে গিয়ে অফিসে গেলো৷ বললো আমাকে তিন লাখ টাকা দেবে৷ সঙ্গে প্রমোশন৷ সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিটিয়ে নিতে৷ বাজারে তখন আমার অনেক ধার৷ তোর ইলেভেনের টিচারের খরচ৷ তাও পারিনি বিক্রি হতে৷ তোরা বিক্রি হয়ে গেলি? ফুটবলটা যে শুধু একটা খেলা না রে৷ এটা একটা লড়াই৷ বেঁচে থাকার লড়াই৷ রোজ লড়তে হয়৷ বিশ্বাসঘাতকতা করে এই লড়াইয়ে জেতা যায় না রে৷ আমি আজ দুপুরেই ঘরে খামটা পেয়েছি৷ সন্দেহটা তখনই হয়েছে৷ আমি নিয়ে এসেছি সঙ্গে৷ বিকাশ তোর বোন খেলা দেখতে এসেছে রে৷ এই খেলা দেখে বাড়ি যাবে? সুখেন যদি তুই সত্যিই আমাকে ভালোবাসিস তাহলে ম্যাচটা জেত৷ কিভাবে জিতবি আমি জানি না৷ জেত৷ জিতে টাকার খামটা লোকটার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে আয়৷’

সাইড লাইনে ওরা দুজন যখন পৌঁছালো দেখলো নবীন আর সৌরভকে ডেকে দীপুদা বোঝাচ্ছে৷ অর্থাৎ সুখেন আর বিকাশ দু’জনকেই বসিয়ে দেবে৷ হঠাৎ সুখেনের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার চোখাচুখি হলো৷ মুখটা ঘুরিয়ে নিলো মেয়েটা৷ 

সুখেন আর বিকাশ মাথা নীচু করে দীপু স্যারের পাশে দাঁড়ালো৷

‘বসে যা তোরা৷ আর এই বেঞ্চে তোদের কোন জায়গা নেই৷ যা ইয়ং স্টারের বেঞ্চে গিয়ে বস৷ 

‘স্যার’৷ 

‘ঠাঁটিয়ে এক চড় মারবো৷ আর একবার আমাকে স্যার বলে ডাকলে৷ তোদের মুখে আমার থুতু দিতে ইচ্ছ করছে৷’

‘২০ মিনিট সময় দিন৷ নাহলে তুলে নেবেন৷’

কেন? এখন পুরো টাকার কাজ করে উঠতে পারিস নি?’

‘বললাম তো স্যার৷ ২০ মিনিট৷’

খেলাটা আবার শুরু হলো৷ থ্রো ইন৷ থ্রো করতে গেলো সুখেন৷ উড়ে আসা বেশ কয়েকটা কথা কানে গেলো ওর৷

‘বিশ্বাসঘাতক৷’ বিক্রি হয়ে গেলি? ‘এই বাবার এই ছেলে তুই?’ ‘কত পেলি রে কত?’ 

চোখটা ছলছল করছে৷ কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলো সুখেন৷  দেখলো ইয়ং স্টার খেলায় কিছুটা ঢিলে ঢালা ভাব৷ ওরা ধরেই নিয়েছে জিতেই গেছে৷

সুখেন খেলাটাকে সুইচ ওভার করলো৷ বাঁদিকে সৌম্যকে বল দিলো৷ ছেলেটা মারাত্মক ছোটে৷ একটা কর্নার নিয়ে নিয়েছে৷ প্রগতির ফার্স্ট কর্নার৷

হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সুখেন একটা হেড করলো৷ ক্রসবারে লেগে ফিরে এলো৷ কাউন্টারে উঠছে ইয়ংস্টার৷ নীচে একা বিষ্ণু৷ বিষ্ণুকে কাটিয়ে গোলে শট নিলো ওদের লেফট হাফটা৷ সুখেন চোখ বন্ধ করে ফেললো৷ হঠাৎ দীপু স্যার চিৎকার করে উঠলেন ‘সাবাশশশশ বিকাশ৷ সাবাশশশশশ৷’

বিকাশ বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ আবার অ্যাটাকে উঠছে প্রগতি৷ সাইড লাইন দিয়ে ওদের কোচ চিৎকার করছে৷ ‘পুশ আপ বয়েজ পুশ আপ৷’

সুখেন যখন বলটা ধরলো৷ সামনে ওদের সেন্টার মিডফিল্ডার৷ সুখেন কাটিয়ে নিয়েই পাশ বাড়ালো দীনেশকে৷ বাচ্চা ছেলেটা আজই প্রথম খেলছে৷ পুরো ডিফেন্স কেটে গেছে পাশটায়৷ দীনেশ একা গোলকিপারের ডান দিক থেকে বলটা জালে ঠেললো৷ গোলললল ৷

গোল করেই ছেলেটা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে সুখেনকে৷  ঘুরে একবার বিকাশকে দেখলো৷ ছেলেটা পাগলের মতো চিৎকার করছে৷ দীপু স্যার চেচাচ্ছেন৷ ‘গো বয়েজ৷ কিল দেম৷ কিল দেম৷ সাত মিনিট বাকি৷’ 

আবার একটা কর্নার৷ ওদের গোলকিপারটা বলটা ফিস্ট করেছে৷ সুখেন বক্সের বাইরে দাঁড়িয়ে বলটা পেলো৷ যা থাকে কপালে ভেবে শট নিলো৷ ‘গোওললল চিৎকারে কান পাতা দায়৷ সারা মাঠ চিৎকার করছে৷ সুখেনের উপর সবাই ঝাঁপিয়ে পডেছে৷ মাইকে ঘোষণা করা হলো পাঁচ মিনিট এক্সট্রা টাইম৷

হঠাৎ পেনাল্টি পেয়ে গেলো ইয়ং স্টার৷ সুখেনের মনে হলো সিদ্ধান্তটা বাড়াবাড়ি হলো৷ সব শেষ হয়ে গেলো৷ পারলো না৷ আর পারলো না৷ বাবার কথা রাখতে পারলো না৷ ওদের ফরোয়ার্ডটা পেনাল্টি মারতে যাচ্ছে৷ রেফারি বাঁশি দিলো৷  চোখ বুজলো৷ ওর মনে হলো পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে যাচ্ছে৷ হঠাৎ একটা চিৎকার৷

‘ইইইই শুনে রাখ৷ বিকাশকে কেনা তো সহজ না৷ তোদের টাকা তোদের মুখে ছুঁড়ে মারি আমি৷ আমি বিশ্বাসঘাতক নই৷’ 

বিকাশ  পেনাল্টি সেভ করে দিয়েছে৷ আর দিয়েই ছুটে গেছে ওদের রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে৷ লম্বা লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে এখন৷ 

কোনরকমে বাকিরা ওকে টেনে এনেছে৷ বিকাশ সুখেনকেই ডাকছে৷

‘আর দু মিনিট বাকি৷ শোন৷ তুই বলটা ডান দিকে খেলা৷ র লেফট ব্যাকটা খোঁড়াচ্ছে৷ বিট্টু ঢুকে গিয়ে ক্রস রাখলে তুই সেটা রিচ করবি৷ চ ভাই চ৷ হাতে সময় খুব কম৷’ 

সুখেন এখন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে৷ বিকাশের কথা মতোই  বলটা ডান দিকে বাড়ালো৷ ওদের লেফট ব্যাকের পাশ থেকে কিছু অবলীলায় বলটা টেনে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো৷ একটা ক্রস করলো৷ সুখেন একটা হাফভলি মারলো৷ বলটা বারে লাগলো৷ বারে লেগে বলটা এখন দীনেশের কাছে৷ ওর সামনে একটা স্টপার৷  শট না মেরে আবার বিট্টুকে দিলো৷ বিট্টু গোলার মতো শট মারলো৷ তারপরই একটা বিষ্ফোরণ৷

গোওললল৷ মাঠে লোক ঢুকে পড়েছে৷

সুখেন মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে৷ হাপুস নয়নে কাঁদছে৷ পিছন থেকে এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো৷

 ‘ভাই পেরেছি ভাই৷ আমরা পেরেছি৷ আমাদের ওরা কিনতে পারেনি৷ আমরা জিতে গেছি৷ আজ ম্যাচটা শুধু না৷ আমরা জীবনটাই জিতে গেছি৷’ 

সুখেন উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো দীপু স্যার ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন৷ পাশে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে৷ মুখের মধ্যে একটা ক্ষমা চাওয়ার আকুতি৷

ওর বাবা ওর হাতে এসে খামটা গুজে দিলেন৷ 

সুখেন আর বিকাশ সোজা চলে গেলো ওই লম্বা লোকটার কাছে৷

বিকাশ শুরু করল৷

‘ওই শোন৷ এই নে সুখেনের কুড়ি৷ আমার কুড়ি বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসিস৷ আর শোন৷ খেলে জেত৷ আমার বোনের যদি বিয়ে ভেঙে যায়, তবু  জানবে ওর দাদা বিশ্বাসঘাতক নয়৷ বিক্রি হয়ে যায় নি৷ আর সুখেনের বাবা? এখন ওনার মরে গেলে আফসোস থাকবে না৷ ছেলেটা জিতে গেছে৷ যে ম্যাচটা জেতার ছিলো সেটাই৷’

ওরা ফিরছিলো ভিড়ের দিকে৷ পিছনে লম্বা লোকটার দম্ভগুলো ভেঙেচুড়ে দিয়ে ওরা ফিরছিলো৷ ওদের শরীর থেকে ঘামগুলো মাঠের ঘাসে মিশে যাচ্ছিলো৷ প্রতিটা ঘামের ফোঁটা যেন ওদের হয়ে চেঁচিয়ে বলছিলো৷ ‘আমরা বিশ্বাসঘাতক নই৷’

শেষ


Powered by Froala Editor