Search

Suggested keywords:

পাড়ার ফুটবল থেকে বার্মিংহ্যাম নেক্সট-জেন কাপে ম্যাচ অফিসিয়ালের ভূমিকায়

পাড়ার ফুটবল থেকে বার্মিংহ্যাম নেক্সট-জেন কাপে ম্যাচ অফিসিয়ালের ভূমিকায়

সালটা খুব সম্ভবত ২০০৯। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমন্ডল তখন এক যুগ সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে। কারণটা নিশ্চয়ই কারুর কাছেই অজানা নয়। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার একেবারে অন্তিমলগ্ন। এমনই সময় কলকাতার ময়দান মার্কেট থেকে ফুটবল খেলার সরঞ্জাম কিনতে এসেছিলেন সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অখ্যাত যুবক। অনেকের মনে হতেই পারে, এটা আবার এমনকি! হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে সর্বদাই কোলাহলে পূর্ণ ময়দান মার্কেট চত্বর। কিন্তু তিনি হয়ে উঠলেন পরবর্তীকালে বিদেশের মাটিতে ২০২৪ নেক্সট-জেন কাপের বাঙালি ম্যাচ অফিসিয়াল। কৈশোরে তিনি 'মৌসুমী সংঘ' নামের ফুটবল দলকে ভরসা জুগিয়েছিলেন তেকাঠির নীচে খেলে। উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট সাব-ডিভিশনের অন্তর্গত বামনপুকুরের এই বাসিন্দা প্রতীক মন্ডলের ফুটবল রেফারী হয়ে ওঠার পথ একেবারেই মসৃণ ছিল না। সেদিন ময়দান মার্কেটে খেলার উপকরণ কিনতে এলেও, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল 'ক্যালকাটা রেফারিস অ্যাসোসিয়েশনের' উপর। হঠাৎই তাঁর মনে উদগ্র বাসনা জাগলো রেফারিং কে জীবনের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার। ব্যাস আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বছর কুড়ির এই তরুণকে। 


pratik mondal aiff referee from west bengal


তৎকালীন রেফারিস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কমল সরকারের সৌজন্যে নাম নথিভুক্ত করান প্রতীক মন্ডল । কিন্তু তিনি যখন পেশাদার ম্যাচ পরিচালক হিসেবে তাঁর পথ চলা শুরু করেন, তখন সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন উদয়ন হালদার। তাঁর হাত ধরে বেশ কিছু বাঙালি রেফারি কলকাতা ময়দান তথা জাতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, প্রতীক মন্ডল তাঁদেরই একজন। জাতীয় রেফারি হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে 'ফিউচার ইন্ডিয়া প্রজেক্ট' ( ২০১০ সালে শঙ্কর কমলেশ্বরম ও কর্নেল গৌতম কর, তৎকালীন এ. আই. এফ. এফ রেফারিং ডিরেক্টর, এটির সূচনা করেন ) এর অনস্বীকার্য অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। তৃণমূল স্তরে প্রতিভা অন্বেষণের ক্ষেত্রে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন কৃত এই প্রকল্প। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ ফুটবল মরশুমের ভারতের শ্রেষ্ঠ রেফারির তকমা যিনি পেয়েছেন অর্থাৎ রামাচন্দ্রন ভেঙ্কাটেশও এই প্রকল্পেরই ফসল। ২০১৫ সালে জাতীয় রেফারির পর্যায়ে উন্নীত হন এবং ২০১৬ তে বাঁশি হাতে আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনের ম্যাচগুলি পরিচালনার সুযোগ পান প্রতীক। পেশাদার ম্যাচ অফিসিয়াল হওয়ার পর কেটে যায় সাতটি বছর। তখনও পর্যন্ত জীবন সংগ্রামের সেই তিক্ত স্বাদটা টের পাননি তিনি। কিন্তু, বিপত্তি ঠিক তখনই ঘটল যখন প্রতীক তাঁর জীবনের পরবর্তী পর্ব গুলিতে পথ চলা শুরু করলেন। 



২০১৬-১৭ আই লিগ মরশুমের ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম তিনটি ম্যাচ পরিচালনা করার পর জীবনের প্রথম বড়ো ধাক্কাটা পেলেন তিনি। ম্যাচ অফিসিয়ালের ভূমিকায় পুনে ফুটবল ক্লাব- ডি.এস.কে শিবাজীয়ান্স এর মধ্যেকার নব্বই মিনিটের ফুটবল যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে কোমরের চোটের কবলে পড়তে হয়েছিল প্রতীককে। ম্যাচ চলাকালীনই আচমকাই তাঁর চোট লাগে। এরপর চলতি মরশুমের আইজল-শিলং ম্যাচ আর প্রতীক মন্ডলের পরিচালনা করা হয়নি। এইভাবে তাঁর রেফারিং ক্যারিয়ারের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু। চোট এতটাই গুরুতর ছিল যে তাঁকে প্রায় সাত থেকে আট মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল। ফুটবল বডি কন্ট্যাক্ট গেম, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে এই পেশার সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যাক্তির চোট-আঘাত লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা যখন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখনই এই পেশার শারীরবৃত্তীও ক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মানুষটির বাউন্স ব্যাক করার প্রায় সমস্ত পথই রুদ্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় আড়াইশো দিন ফুটবলের মাঠ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়ায় ক্রমে ক্রমে হতাশা তাঁর চিন্তনও মনন কে গ্রাস করেছিল। বলাইবাহুল্য, এক দমবন্ধকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে একটা সময়ে জীবনের চরমতম কঠিন সিদ্ধান্তটি প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন প্রতীক। অর্থাৎ, রেফারিং ক্যারিয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে জীবনকে অন্য পথে চালিত করার কথা। 


pratik mondal aiff referee from west bengal


তাঁর দুঃসময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে তিন শুভাকাঙ্খীদের নাম উল্লেখ করলেন তাঁদের একজন হলেন তৎকালীন 'ক্যালকাটা রেফারিস অ্যাসোসিয়েশনের' সহকারী সম্পাদক জয়ন্ত ব্যানার্জী, সম্পাদক উদয়ন হালদার ও সমসাময়িক দেশের ফুটবল ফেডারেশনের রেফারিং ডিরেক্টর কর্নেল গৌতম কর। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে গিয়ে প্রতীক মন্ডল জানান "জয়ন্ত ব্যানার্জী স্যারের হাতেই আমার রেফারিং জীবনের হাতেখড়ি। তিনি আমায় প্রথম বিভিন্ন জেলার সাব-ডিভিশন বা নিম্ন-ডিভিশনের ম্যাচ গুলো পরিচালনা করার সুযোগ করে দিতেন। এই প্রসঙ্গে শ্রীরামপুর আঞ্চলিক ম্যাচ গুলির কথা বলতেই হবে। আমার মতো অনেক তরুণ তুর্কিদের মাঠমুখী করার ক্ষেত্রে তাঁর নিঃস্বার্থ অবদান রয়েছে। পাশাপাশি আমার কঠিন সময়ে গৌতম স্যারের মতো সদা-ব্যাস্তময় মানুষটির পাশে থাকা আমি কোনোদিনও ভুলবো না। কোমরের আঘাত আমাকে মাঠ থেকে ছিটকে দিলেও জীবন যুদ্ধের লড়াইতে ফিরে আসতে তিনি আমাকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করতেন। প্রায় প্রতিটি সপ্তাহান্তে ফোন করে আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতেন। আর যে মানুষটির কথা না বললেই নয় তিনি হলেন উদয়ন স্যার! আর্থিক দুর্দিনে যেভাবে উনি ঢাল হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তার জন্য আমি ঋণী হয়ে থাকবো। উনি না থাকলে বোধহয় রেফারি প্রতীক মন্ডল হয়ে উঠতে পারতাম না"। তিনি  আরও জানান "কিছুতেই যেন চোট আমার পিছু ছাড়ছিলো না। রিহ্যাব করে ক্ষণিকের জন্য সেরে উঠলেও প্রাকটিসের সময় আবার সেই ব্যথা ফিরে ফিরে হানা দিতো কোমরে "। 


যদিও তাঁর শুভাকাঙ্খীরা কঠিন সময়ে রেফারি প্রতীক মন্ডলের চোয়াল চেপে বা মাটি কামড়ে থাকা হার না মানা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিত্তের প্রশংসা করেছেন। এই প্রসঙ্গে রেফারিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সহকারী সম্পাদক জয়ন্ত ব্যানার্জী জানিয়েছেন "জীবনের লড়াইটা নিজেকেই করতে হয় এবং সেটা প্রতীক অনবদ্যতার সাথে করে দেখিয়েছে। বিপদের দিনে ও নিজেই নিজের শক্ত খুঁটি হয়ে উঠেছিল। আমরা কেবল ওঁর পাশে থেকেছি মাত্র"। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন "কোভিড মহামারির সময় প্রতীক ওঁর বাবা মধুসূদন মন্ডলকে হারায়। সেটা ছিল প্রতীকের জীবনের দ্বিতীয় বড়ো ধাক্কা। পারিবারিক সূত্রে,  ম্যাচ পরিচালনার পাশাপাশি বাবার কাপড়ের ব্যবসাও দেখাশোনা করতে হতো ওকে। ওঁর বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে ব্যাবসায়িক অবনতি শুরু হয়েছিল। কাপড়ের পাশাপাশি ওঁদের মাছের ভেড়িও ছিল। কঠিন সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে সমস্তরকমের প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করেছিল প্রতীক"। তাঁর অতীত দিন গুলির কথা বলতে গিয়ে গৌতম কর জানান " আমার জীবনে দেখা জেদি ছেলেদের মধ্যে ও একজন। নিজের পেশার প্রতি ওঁর নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও কঠোর পরিশ্রম আজ ওঁকে এই জায়গায় নিয়ে গেছে। খেলা চলাকালীন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতীকের দূরদর্শিতা আমায় সবথেকে থেকে বেশী মুগ্ধ করেছিল"। 


প্রকৃত অর্থে রেফারি প্রতীক মন্ডলের হার মানা মানসিকতাই তাঁকে তাঁর সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের মতো দেশের প্রথম সারির ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাঙালি রেফারি হিসেবে প্রাঞ্জল ব্যানার্জী, উজ্জ্বল হালদার এবং আদিত্য পুরকাইতের পর তিনি কড়া হাতে মাঠে বিদেশী ও স্বদেশী খেলোয়াড়দের সামলান। এই প্রসঙ্গে প্রতীক জানান "সবথেকে বেশী যে ম্যাচটি উপভোগ করি তা হল কেরালা-বেঙ্গালুরু এফ সি ম্যাচ। দর্শকে ঠাসা কোচির জহরলাল নেহেরুর শব্দব্রহ্ম আমাকে ম্যাচ পরিচালনার সময় বিশেষভাবে উত্তেজিত করে"। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত নেক্সট-জেন কাপ ২০২৪ এ প্রথম বাঙালি হিসেবে প্রধান ম্যাচ অফিসিয়ালের ভূমিকায় তাঁকে দেখা যায়। টটেনহ্যাম হটস্পর- মুথুট এফ সি এবং এস্টনভিলা-পাঞ্জাব এফ সির মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলিতে রেফারিং বাঁশি হাতে দেখা যায় প্রতীক মন্ডল কে। 


তাঁর এই জীবন যুদ্ধের কাহিনী আগামী তরুন প্রজন্মের রেফারিদের কাছে অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

Powered by Froala Editor